চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নাফ নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছি আমাদের মানবতা

মিয়ানমার সরকারী বাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে রাখাইন রাজ্য হতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে সাগরে নৌকাডুবিতে বৃহস্পতিবার মৃত্যু হয়েছে ১৯ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর। তাদের মধ্যে ১০ জন শিশু এবং ৯ জন নারী। এ নিয়ে গত দুইদিনে ২৩ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হলো। যারা সবাই নারী ও শিশু। বুধবার ভোরে সাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় দুই নারী ও শিশুসহ চার জনের মরদেহ পাওয়া যায়।

এভাবে কক্সবাজার মৃত্যু নগরীতে পরিণত হয়েছে। বাড়ছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর মিছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই জীবন সংকটে বিশ্ব বিবেক এখনো নিরব, এর সমস্য সমাধান খুঁজতে জোড়ালো কোন পদক্ষেপ নিতে এখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশের অবস্থা ১৯৭১ সালে এমনি ছিলো বলে মনে করেন উন্নয়নকর্মী ফাহউদ খান।

তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন:

ঈশ্বর বাস করেন কোথায়? কেউ বলবেন সাত আসমানের উপরে কেউ বলবে হিমালয়, মন্দির মসজিদের আবার কেউ বলবে আমাদের হৃদয়ে। কিন্তু কিছুদিনের অভিজ্ঞতায় দেখলাম আসলে ঈশ্বর বাস করেন কাঁটাতারের ওপারে। সারা পৃথিবীজুড়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিদিনের একটা ছবি থাকে একদল অসহায় মানুষ যা কাঁটাতারের ওপারে। এর কোন ভৌগলিক বিন্যাস নাই। সবখানের চিত্রই সমান। পানিতে শিশুর লাশ, স্বামী সন্তান হারানো নারী সে তুরস্ক, হাঙ্গেরির সীমান্ত হোক অথবা বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত সবখানে একই চিত্র। চেহারা ভিন্ন কিন্তু চিত্র এক। বাচার আকুতি, জীবনের আকুতি। ভিটেমাটি হারা মানুষগুলোর শূন্য দৃষ্টি আর স্বজন হারানোর বেদনা।

আমার শৈশবকালে যখন মায়ের সাথে কোথাও যেতাম তখন সব আলোচনার মধ্যে এক অন্যতম বিষয় শুনতাম ৭১ এর স্মৃতি। সেসময়ের বাংলাদেশের লক্ষ কোটি পরিবারের মতো মার পরিবারকেও ছুটে বেড়াতে হয়েছে এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, এ ঘর থেকে ও ঘর। স্বামী মুক্তিযুদ্ধে, একা তিন শিশু সন্তান এবং গর্ভে ৪র্থ নিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে খুঁজে ফিরেছেন নিরাপদ আশ্রয়। নিজের সাজানো সংসার পিছনে ফেলে এক অনিশ্চিত জীবন। যতবার সে গল্প শুনতাম ততোবার দুই চোখ ভিজিয়ে কান্না শুরু করতাম। এ গল্প আমার মায়ের একার ছিলো না। কম বেশী সবাই সেসময়ে একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। আমার মা ভাগ্যবতী ছিলেন, ৯ মাস পর যুদ্ধ শেষে আবার তিনি সব ফিরে পেয়েছিলেন। সময়ের সাথে তার জীবন সব গুছিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকের জীবনে তা হয়নি। আমার পিতার এক সহযোদ্ধার মাকে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়েছিলো, অন্য একজন শহীদ সহকর্মীর স্ত্রী দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় তার কিশোর পুত্রকে নিতে হয়েছিলো সংসারের ভার । আবার অনেক পরিবার বানের জলের মতো কোথায় ভেসে গেছে তার খবর কার কাছে আছে?

গত বেশ কিছুদিন থেকে আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো সরব রোহিংগা ইস্যু নিয়ে। বড় বড় অক্ষরে এবং চিত্রে তাদের অসহায়ত্বের ছবি। নৌকা, খোলা মাঠ, সীমান্ত চৌকি সবখানে তাদের অসহায় উপস্থিতি। ছোট ছোট শিশু, বৃদ্ধা, নারীর হাহাকার সঙ্গে আমাদের সিমান্তরক্ষীদের বন্দুকের নল। খুবই বেদনাদায়ক! যতবার দেখি ততবার মনে হয় মানুষগুলোকে যেন সাক্ষাত মৃত্যুর মুখে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিচ্ছি। নারী আর শিশু ভর্তি যে নৌকা আমরা ফিরে যেতে বাধ্য করছি তারা যেন লাশ হয়ে আমার নদীর কিনারে ভেসে উঠছে। তাদের কোন স্বজন নাই, সমাজ নাই, রাষ্ট্র নাই এমনকি ঈশ্বরও নাই। তাদের জন্য না আমার হৃদয় কাঁদে না, কাপে না খোদার আরশ। দুনিয়ার সব দরজা আজ তাদের জন্য বন্ধ।

আমার কোথায় অনেকে বলবে এরা বাংলাদেশের নাগরিক নয় এদের জন্য আমাদের দায় কি? তাদের বলি ৭১ আমরা ভারতের নাগরিক ছিলাম না। কিন্তু বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষ তাদের দেশে আশ্রয় পেয়েছিলো। সেসময় ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা এমন কোন ভালো অবস্থায় ছিল না। কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো, জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ কিন্তু তারাও তাদের দেশে সিরিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ সহ হৃদয়ের সব দরজা বন্ধ করে রেখেছি। নাফ নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছি আমাদের মানবিকতা আমাদের তালা বন্ধ হৃদয়ের চাবি। ইয়াবার জন্য আমরা সীমান্ত খুলে রেখেছি কিন্তু অসহায় মানুষের জন্য নয়। তাই কাঁটাতারের এপারে অসহায় মানুষগুলো যে ঈশ্বর খোজে, তা কবেই মারা গেছে। রোহিঙ্গারা জানেনা কিন্তু আমরা জানি। রোহিঙ্গারা মরতে মরতে একদিন হয়তো শেষ হয়ে যাবে কিন্তু আমাদের কি হবে?