বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১০০ কোটির মতো মানুষ ভাইরাসজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এর মধ্যে ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ৬ লাখ পর্যন্ত মানুষ মারা যায়। প্রতিবছরই এসব ভাইরাসের ভয়াবহতার মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে থাকে যা বাংলাদেশেও বিদ্যমান।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে ভাইরাসজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত বা সাধারণ রোগীও তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারছে না-বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদগুলো পুরো জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে-ঘুরে স্বাস্থ্য সেবা না পেয়ে শিশুসহ মৃত্যুবরণ করেছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাও। সাধারণ রোগী কোনও হাসপাতালে গেলে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে ভেবে কতিপয় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্তব্যরত কর্মকর্তা তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে আবার সামাজিক দূরত্ব তিন ফুটের চেয়ে অনেক বেশি দূরত্ব বজায় রেখে কোনো রকম দায়সারা মৌখিক বা লিখিতভাবে কিছু ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এটি এখন বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করেছে। করোনাভাইরাসের উপসর্গগুলো নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের চেয়ে চিকিৎসক মহল অনেক বেশি অভিজ্ঞ এবং প্রতিটি রোগীর সাথে আলোচনা করার মাধ্যমেই জানা সম্ভব-কোনটি সাধারণ রোগ আর কোনটি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে।
কিন্তু এটি যাচাই করার আগেই, রোগীর মূল বক্তব্য শোনার আগেই-এই হাসপাতল নয় ওই হাসপাতালে পাঠানোর মাধ্যমে মূলত সাধারণ রোগীকে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সন্দেহ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে রোগীর মানসিক শক্তিকে হত্যা করা হচ্ছে। সাধারণ রোগী নিজেকে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়-উৎকন্ঠা আর তার একান্ত ভাবনাগুলো যখন ‘কথা’ হয়ে বের হয়, তখন এক কান থেকে দশ কানে পৌঁছানোর মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সাথে-সাথে এলাকার অন্যান্য মানুষের মাঝেও একধরণের অজানা ভয় বা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আর এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে যতবারই বলা হোক- ভৈরবের মৃত ব্যক্তির শরীরে ‘করোনাভাইরাস জীবাণু’ পাওয়া যায়নি-এটি বিশ্বাস করতে দেশের সাধারণ মানুষ মানসিকভাবে শক্তি হারিয়ে ফেলে, অবিশ্বাস ডানা মেলে!
সে সাথে দেশের প্রথমসারির কিছু গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম- করোনা সন্দেহে ওমুক এলাকায় দুইজন মারা গেছে, করোনাভাইরাস সন্দেহে রোগীকে ওমুক হামপাতালে ভর্তি না করিয়ে ওমুক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে-খবরগুলো আরও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, করছে। অন্যদিকে করোনাভাইরাস নিয়ে এই পর্যন্ত সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোতে কোনও সমন্বয়ও দেখা যায়নি। সকালে একটা বললে বিকালে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে কোনও নির্দেশনাকে সংবাদ সম্মেলনে বলার পরক্ষণেই আবার সেটির জন্য দুঃখপ্রকাশগুলোও-সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে, আতঙ্কিত করে তুলে। কী হচ্ছে, কী হবে, ভেতরে ভেতরে কী ঘটে চলেছে-বিষয়গুলো মানুষের মনে বিচরণ করতে দেখা যায়। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ভাইরাল হয়ে থাকে। সন্দেহজনক মতামত ছড়িয়ে পড়ে।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের সচেতনতার সূচকগুলো নিয়েই আমাদের মহা-ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। একশ্রেণির মানুষ মরার আগে নিজেও মরে, অন্যকেও মারে। চারপাশে ভয়, আতঙ্ক ছড়ানোর আগে সবাইকে ঘুরে দাঁড়ানোর মনোবল সৃষ্টি করতে সরকারের পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসের সার্বিক তথ্য জানাতে একটি ‘তথ্য কেন্দ্র’ বা ‘একজন মুখপত্র’ অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। যেখান থেকে সংবাদকর্মী ও দেশের মানুষ করোনাভাইরাসের সর্বশেষ তথ্য জানতে পারবে। সেসাথে সাধারণ রোগী যে হাসপাতালে যাবে সেখানেই রোগের বিস্তারিত জেনে করোনাভাইরাস ব্যাতিত সবাইকে তার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার উপসর্গগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে তাকে আলাদা করার মাধ্যমে সেখান থেকে সরাসরি আইইডিসিআর-এর তত্ত্বাবধানে সেটা পরামর্শ হোক কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হোক তার সুব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে হিবে। রোগীর মানসিক মনোবল মজবুত করতে দায়িত্বরত চিকিৎসকসহ আমাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। মরার আগেই তাদের মরতে দেওয়া যাবে না, মারা যাবে না।
আমাদের কিছু অব্যবস্থাপনা, কতিপয় হাসপাতালের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের করোনাভাইরাসের ভয়, দূরত্বের নামে অবহেলাগুলো সাধারণ রোগীও একটা সময় নিজেকে করোনাভাইরাস রোগী ভাবতে বাধ্য হয়েছে, হচ্ছে। তাই নিজেরা হন্য হয়ে দ্বিগবিদ্বিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এজন-সেজনকে বলে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। ফলে চারপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সব রোগী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে-এমন ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসতে দায়িত্ববান ব্যক্তিবর্গসহ সবাইকে আন্তরিক হতে হবে, যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সর্বপরি সরকারিভাবে প্রচার-প্রকাশসহ নানা ধরণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। সে সাথে হাসপাতালগুলোতে সাধারণ রোগীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে মনিটরিং করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বনের বাঘে খায়না, মনের বাঘই কিন্তু খায়। আমি-আপনি যখনই কোনও কিছু নিয়ে ভয়-উৎকন্ঠা আর হতাশা মাঝে থাকি, তখন আমাদের সুন্দর চিন্তা ভাবনাগুলো লোপ পায়। অত্যন্ত সহজ কাজটিও নিজেরাই কঠিন করে তুলি। সুস্থ ও সময় উপযোগি পরিকল্পনা-সিদ্ধান্ত থেকে আমরা দূরে সরে যাই। আর বিপদ থেকে উত্তরণের দিকবিদিক ছুটে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু অজানা, অচেনা পথের শেষ কোথায়-এটা নিশ্চয়ই বলা কঠিন। তাই আগে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং পরিকল্পনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শুধু করোনাভাইরাসই নয়, যেকোনো সংকট মোকাবেলা করা সহজ, মসৃন হয় উত্তরণের পথ-পদ্ধতিও। সময় উপযোগি ব্যবস্থাপনা আর আমাদের সবার দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতায় নিশ্চয় করোনাভাইরাসকেও আমরা পরজিত করবো।(
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)