সাত নভেম্বর মানেই জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠার দিন। সেদিন হেরে যান খালেদ মোশারফ, সেনাবাহিনী প্রধানের পদে থেকেও জীবন দিয়ে অভ্যুত্থান দায় পরিশোধ করেছেন। নিহত হয়েছেন সেনাসদস্যদের হাতেই। আরো আলোচিত কর্নেল আবু তাহের। পরে কারাগারে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলেছেন তিনি। এখন প্রতি বছর নভেম্বরে আলোচিত হয় তাদের নাম। কিন্তৃ বিস্মৃতিতে আছেন আরো দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা নিহত হয়েছিলেন খালেদ মোশারফের সাথেই। এদের একজন কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং অপরজন হলেন লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম।
কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক দল জাসদ এখন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক। আর খালেদ মোশাররফের মেয়ে মেহজাবীন খালেদ ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ। ৭ নভেম্বর দুজনকে নিয়েই কথা হয়েছে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় কিন্তু কোনো কথা নেই কর্নেল হুদা বা লে. কনের্ল হায়দারকে নিয়ে। এ বছর সাত নভেম্বরে আমরা কথা বলার চেষ্টা করেছি এই দুই সেনা কর্মকর্তার পরিবারের সাথে । কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদার স্ত্রী নীলুফার হুদা, ছেলে এহতেশাম হুদা এবং এ টি এম হায়দারের বোন আখতার বেগমের সাথে। ‘উপসংহার’-এর আলোচনায় বারবার এসেছে এই দুজনের নাম। সেই আলোচনায় খালেদ মোশাররফের মেয়ে মেহজাবীন খালেদ জানিয়েছিলেন যে তিনি বাবার হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলা করতে চান। ডিবিসি নিউজকে দেয়া সাক্ষাতকারে এহতেশাম হুদা বলেছেন যে তার বাবাতো সেনাবাহিনীতে চাকুরীরত অবস্থায় মারা গেছেন। সেজন্য সেই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যা করার করতে হবে সেনাবাহিনীকেই। সেনাসদ্যদের হাতেই তিনি মারা গেছেন তাই এখন সেনাবাহিনীর জন্য এটা হাইটাইম, তারাই যেন তদন্ত করে যে কর্নেল হুদা কাদের হাতে মারা গেলেন।
কর্নেল হায়দারের বোন আখতার বেগম জানিয়েছেন, ছুটিতে ঢাকায় এসেছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ‘সে তো নির্দোষ ছিল, কেন তাকে মরতে হলো?’ সরকারের কাছে ভাইয়ের হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেছেন, বাবা মা দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু আমরা ভাইবোনরা দেখে যেতে চাই ভাই হত্যার বিচার। সরকারই সেই বিচার করতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
৭ নভেম্বরে নিহত কর্নেল হুদা আর হায়দারকে নিয়ে কমই জানি আমরা। ১৯৭৫ সালে রংপুর সেনানিবাসের দায়িত্বে ছিলেন হুদা। সেখান থেকেই ঢাকায় এসেছিলেন মূলত খালেদ মোশাররফের নির্দেশে। তার তার নিহত হওয়া নিয়ে কথা হয়, কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না যে কর্নেল হুদা ছিলেন ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার আসামী। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে আগরতলা মামলার আসামী হিসেবে তার সাথে বন্দী হয়েছিলেন। কর্নেল হুদার স্ত্রী নীলুফার হুদা তার “কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ” বইতে লিখেছেন আগরতলা মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে তার দেখা হওয়ার কথা। সামরিক আদালতে বিচারের সময় নিজের স্বামী তখনকার ক্যাপ্টেন নাজমূল হুদার সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রথম দেখেছিলেন বাংলার এই অবিসম্বাদিত নেতাকে। নীলুফার হুদা লিখেছেন: শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন “তুই একটুও ভয় পাবি না, আমাদের কিচ্ছু হবে না। আমরা সবাই নির্দোষ। দেখিস, আমরা সবাই সসম্মানে ছাড়া পাবো। একটুও ভয় পাবি না।” ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণে আগরতলা মামলা থেকে আরো ৩৫ জন আসামীর মতো নাজমূল হুদাও বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন, যদিও সেনাবাহিনী থেকে চাকুরিচ্যুত হয়েছিলেন আইয়ুব সরকারের নির্দেশে। সেই নাজমূল হুদা ঝাপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ করে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরেছিলেন, পেয়েছিলেন ‘বীর বিক্রম’ খেতাব। কিন্তু নিজের সতীর্থদের হাতেই নিহত হয়েছিলেন তিনি।
প্রয়াত মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী বীর বিক্রম কর্নেল হুদা সম্পর্কে লিখেছেন “বয়রা সাব-সেক্টরের অকুতোভয় কমান্ডার কর্নেল হুদার অধীনে যুদ্ধরত শহীদ সৈনিক নূর মোহম্মদ বীরত্বের জন্য পেলেন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব।…… ৮ নং সেক্টরে এমনি অসংখ্য যুদ্ধের সমর নায়ক ছিলেন কনের্ল হুদা।” স্বাধীনতার পর সামরিক বাহিনীতে কর্নেল হুদান নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সৈনিক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মাপের। আমিন আহমেদ চৌধুরী আরো লিখেছেন, “স্বাধীনতা উত্তর চাকরিজীবনে তিনি সেনাসদরে এজি ব্রাঞ্চ পুনর্গঠনে রাত-দিন পরিশ্রম করেন। তারপর তিনি বদলি হয়ে গেলেন কুমিল্লায়। বলতে গেলে তিনিই বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম কমান্ডান্ট। একেবারে শূন্য থেকে গড়ে তোলেন মিলিটারি একাডেমি।” আক্ষেপ করেছেন আমিন আহমেদ চৌধুরী “চোয়ালে ২২টি সেলাই নিয়ে পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমির ২৫তম কোর্সের অফিসার হয়েছিলেন, অথচ শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে (৭ নভেম্বর ) খড়ের গাদার মধ্যে পড়ে তাকে মরতে হলো।”
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্ত হয়েছিলেন ২ নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। জহিরুল ইসলামের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তার বিয়োগান্ত বিদায়’ বইটি থেকে জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধে এই বীর সেনানীর বীরত্বের কথা। সে জন্যই তিনি দ্বিতীয় খেতাব বীর উত্তম। তার ছোট বোন ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. সিতারা বেগম বীর প্রতীক। তিনি লিখেছেন, “বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে পারিবারিক কাজে বান্দরবানের রামু থেকে ঢাকায় এসেছিলেন হায়দার। ৬ নভেম্বর দুপুরে তিনি জেনারেল ওসমানী ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় তার প্রিয় সেক্টর কমান্ডার এবং নতুন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের সাথে তার যোগাযোগ হয়। সে রাতে তার সঙ্গে বঙ্গভবনে যান। মধ্যরাতে পাল্টা বিদ্রোহের সময় সেক্টর কমান্ডারকে রেখে চলে আসতে পারেননি। পরদিন কিছু উচ্ছৃংখল জওয়ান ও কর্মকর্তা তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দারকে কাপুরুষের মত হত্যা করে।” সিতারা বেগম প্রশ্ন রেখেছেন, “এই কাপুরোষিত হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার আজো হয়নি। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারে সেনাবাহিনী, নিরাপত্তাবাহিনী ও বিচার বিভাগের কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই?” ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন মেজর হায়দার। জহিরুল ইসলামের বইয়ে সেদিনের বিবরণ: “বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটের সময় সেক্টর-২ এর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার মেজর হায়দার ও মিত্রবাহিনীর কয়েকজন অফিসার যৌথ বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকার এবং পাকিস্তানি জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ও অন্যান্য উর্ধ্বতন পাকিস্তানি অফিসারদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে নিয়ে এলেন।” যুদ্ধজয়ী মেজর হায়দার পরাজিত পাক বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দিয়ে আত্মসমর্পন মঞ্চে নিয়ে যান, কিন্ত স্বাধীন দেশে নিজের সেনাসদস্যদের কয়েকজনই তাকে হত্যা করেছিলো। যিনি ছিলেন একজন “বীর উত্তম”। (শেষ)
(৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে গত অক্টোবর মাস জুড়ে ‘ডিবিসি’ টেলিভিশনে আট পর্বে ‘উপসংহার’ নামে একটি টক-শো করেছেন ডিবিসি নিউজের এডিটর প্রণব সাহা। সেই টক-শোতে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং অন্যান্য বই ও দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি চ্যানেল আই অনলাইন’র জন্য এ ধারাবাহিকটি লিখেছেন। টক-শো’র মতো এখানেও তিনি সবার চোখ দিয়ে ৭৫’র নভেম্বরের ঘটনাগুলোতে দৃষ্টিপাত করে একটি উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন।)