বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাশিল্পী, চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ৬৯তম জন্মবার্ষিকী আজ। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।
ধানমন্ডির দখিন হাওয়ায় হুমায়ূন আহমেদ-এর ৬৯তম জন্মবার্ষিকীর প্রথম প্রহরে কেক কেটে দিনটিকে উদযাপন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ভক্তরা লেখকের সৃষ্টিকর্ম সংরক্ষণে হুমায়ূন স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানান। তার জন্মদিন জাতীয়ভাবে পালনের দাবি জানান ভক্তরা।
প্রতি বছর চ্যানেল আইয়ের পক্ষ থেকেও অত্যন্ত আড়ম্বরভাবে পালন করা হয় তার জন্মদিন। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও নির্মাণের এই কারিগরের জন্মদিন উপলক্ষে চ্যানেল আই ভবনের সামনে চেতনা চত্বরে দিনভর চলবে হুমায়ূন মেলা। যেখানে মিলিত হবেন সারা দেশের অসংখ্য হুমায়ূন ভক্ত। এ বছর হুমায়ূন মেলার পৃষ্ঠপোষকতা করছে এসিআই পিওর সল্ট। পাওয়ার্ড বাই এনআরবি বাজার।
হুমায়ূন আহমেদের পিতার নাম ফয়েজুর রহমান। একাত্তরে পাকাবাহিনী তাকে হত্যা করে। মা আয়েশা ফয়েজ। স্কুল জীবনে হুমায়ূন আহমেদকে পিতার চাকরিস্থল কুমিল্লা, সিলেট, বগুড়া ও পঞ্চঘরসহ বিভিন্ন জেলায় বসবাস করতে হয়। তিনি ১৯৬৭ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (রাজশাহী বিভাগে মেধাতালিকায় দ্বিতীয়), ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্র জীবনেই তার লেখালেখি শুরু। ১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশ পায়। তখন তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শংখনীল কারাগার’। এই দুটি বই প্রকাশের পর হুমায়ূন আহমেদ একজন শক্তিশালী কথাশিল্পী হিসেবে পাঠকমহলে সমাদৃত হন। সেই থেকে জীবিতকালে তার দুই শতাধিক বই প্রকাশিত হয়।
দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন। তার লেখায় বাঙালি সমাজ ও জীবনধারার গল্পমালা ভিন্ন আঙ্গিকে এবং রসাত্বক ও বিজ্ঞানস্মতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গল্প বলায় ভাষার ব্যবহারে নিজস্ব একটা কৌশল এবং বর্ণনায় লোকজধারাকে প্রাধান্য দেন। বাস্তবতা থেকেই উঠে এসেছে তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম। মানুষের মানচিত্রও উঠে এসেছে। বাংলা সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে তাকে পথিকৃৎ বলেছেন সমোলোচকেরা।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক। তিনি সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তার প্রতিভা দেখিয়েছেন আপন মনে। একাধারে তিনি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার। সেজন্যই তাকে বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরক দিয়েই বাংলা কথাসাহিত্যে পালাবদলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর পর শঙ্খনীল কারাগার, লীলাবতী, জোছনা ও জননীর গল্প, মধ্যাহ্ন, বাদশাহ নামদারসহ দু’শোর বেশি উপন্যাস রচনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার উপন্যাসের চরিত্র হিমু, মিসির আলী, শুভ্র বইয়ের পাতা থেকে টেলিভিশনের পর্দা কিংবা সেলুলয়েডে তরুণ-তরুণীদের আপনজন হয়ে ওঠে। ১৯৮০ সালে নাটক রচনা শুরু করেন হুমায়ূন আহমেদ।
তার লেখা নাটক এই সব দিনরাত্রির জনপ্রিয়তার পর তিনি তৈরি করেন বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, উড়ে যায় বকপক্ষীসহ বহু নাটক।
সিনেমা পরিচালক হিসেবেও তার ছিলো প্রচুর সুনাম। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’। এই সিনেমার জন্য তিনি ১৯৯৪ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। একই বছর তিনি একুশে পদক অর্জন করেন। এরপর তিনিও নির্মাণ করেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’ এবং আমার আছে জলসহ বহু চলচ্চিত্র। তার নির্মিত শেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।
তিনি উপন্যাস, গল্প, জীবনী, নাটক ও চলচ্চিত্র নিয়ে করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার লেখা কয়েকটি উপন্যাস, নাটক আর চলচ্চিত্র কালজয়ী কর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে শিক্ষকতা থেকে তিনি অবসর নেন।
শিল্প-সংস্কৃতির প্রসারে হুমায়ূন আহমেদ গাজিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নুহাশ পল্লী’। এই প্রতিষ্ঠানই ছিল তার সকল কাজের আঙ্গিনা। ২০১০ সালে সরকার হুমায়ুন আহমেদকে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করে।
তার প্রকাশিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘হিমুর আছে জল’, ‘লীলাবতী’, ‘হরতন ইস্কাপন’, ‘হিমুর বাবার কথামালা’, ‘আমিও মিসির আলী’, ‘হিমু রিমান্ডে’, ‘মিসির আলীর চশমা’, ‘দিঘির জলে কার ছায়া গো’, ‘আজ হিমুর বিয়ে’, ‘লিলুয়া বাতাস’, ‘কিছু শৈশব’, ‘হুমায়ুন আহমেদের ভৌতিক অমনানিবাস’, ‘আগুনের পরশমনি’, ‘পাপ ৭১’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। তার নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘শংখনীল কারাগার’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’ প্রভৃতি।
সাহিত্যে অবদানের জন্য হুমায়ূন আহমেদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন।
বাংলা শিল্প সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রাখা গুণী এ মানুষটি ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।