সম্পাদক পদের ভোট গণনা নিয়ে সৃষ্ট নজিরবিহীন অচলাবস্থার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতির মধ্যে দিয়েই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিশোধ সমর্থিত আইনজীবী মো. অজি উল্লাহর নেতৃত্বাধীন নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত নতুন উপকমিটি মঙ্গলবার রাতে এই ফলাফল ঘোষণা করেন।
এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে সমিতি ভবনের তিনতলায় অবস্থিত সম্মেলনকক্ষে নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত নতুন উপকমিটির ঢুকতে গেলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়। একপর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতির মধ্যেই তালা ভেঙে সম্মেলনকক্ষে ঢোকেন কমিটি। তবে এসময় ওই কক্ষের জানালার কাচ ভাংচুর হয়। পরবর্তীতে বিকেল চারটার দিকে ভোট গণনা শুরু করে রাত ১০টায় ফলা ঘোষণা করা হয়।
ঘোষিত ফলাফলে সভাপতি, সম্পাদকসহ সাতটি পদে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা। আর দুটি সহসম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ সাতটি পদে জয়ী হয়েছেন বিএনপি-সমর্থিত নীল প্যানেলের প্রার্থীরা। সভাপতি পদে সাদা প্যানেলের মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির জয়ী হয়েছেন। আর এবারের নির্বাচনের আলোচিত সম্পাদক পদে সাদা প্যানেলের আবদুন নূর ২ হাজার ৮৯১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী নীল প্যানেলের ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস ২ হাজার ৮৪৬ ভোট পেয়েছেন বলে ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া সাদা প্যানেল থেকে সহসভাপতি দুটি পদে মো. শহীদুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হোসেন এবং সদস্য পদে ফাতেমা বেগম, শাহাদাত হোসেন ও সুব্রত কুমার কুণ্ডু জয়ী হয়েছেন। নীল প্যানেল থেকে সহসম্পাদকের দুটি পদে মাহফুজ বিন ইউসুফ ও মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খান, কোষাধ্যক্ষ পদে মো. কামাল হোসেন এবং চারটি সদস্য পদে মাহদীন চৌধুরী, গোলাম আক্তার জাকির, মঞ্জুরুল আলম ও কামরুল ইসলাম নির্বাচিত হয়েছেন।
তবে গতরাতের ফলাফলকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই বারের সম্পাদক ও একই পদে এবারও লড়া ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,’ যা হলো সেটি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির জন্য লজ্জার। এটি রাজনৈতিক দখলদারিত্বের বহিঃপ্রকাশ। এই ফলাফলকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি।’
গত ১৫ ও ১৬ মার্চ দুই দিনব্যাপী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয়। পরেরদিন ১৭ মার্চ বিকেল সাড়ে চারটায় ভোট গণনা শুরু হয়ে চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। তবে ভোট গননায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনা চেয়ে নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির আহ্বায়কের কাছে এক পর্যায়ে আবেদন জানান আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাদা প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী আবদুন নূর দুলাল। এনিয়ে সেই মধ্যরাতে হইচই-হট্টগোল শুরু হয়। অনেকেই সেই সময় নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির আহ্বায়কের পদত্যাগ চান। সেই সাথে উপস্থিত কয়েকজন আপত্তিকর কথা বলার পাশাপাশি অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন।
সেই রাতের প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন আইনজীবী এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘সমিতির দক্ষিণ হলে তখন অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক এ ওয়াই মসিউজ্জামান ও উপ-কমিটির অন্য সদস্যরা।’
এক পর্যায়ে রাত সাড়ে তিনটার দিকে ভোট গণনার স্থান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে এ ওয়াই মসিউজ্জামান জানান সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনা চেয়ে করা আবেদন দুই পক্ষের উপস্থিতিতে ১৮ মার্চ বেলা তিনটায় নিষ্পত্তি করা হবে। কিন্তু ১৮ মার্চ এ ওয়াই মসিউজ্জামান গণমাধ্যমকে জানান, ‘স্বাস্থ্যগত কারণে ১৭ মার্চ রাত ১টায় সমিতির বিদায়ী কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে আমি পদত্যাগপত্র দিয়ে দিয়েছি। এরপর আর তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে আসেননি এবং উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এবারের নির্বাচনের কোনো পদের ফলাফলই আর ঘোষণা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সম্পাদক পদে ‘ফ্রেশ কাউন্টিং’ চেয়ে আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গনে নিয়মিত মিছিল করে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাদা প্যানেলের কিছু আইনজীবী। এমন প্রেক্ষাপটে গত ৩০ মার্চ বিকেলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির ১৩ তম জরুরি সভা থেকে সিদ্ধান্ত হয় যে, আগামি ৭ দিনের মধ্যে সাবেক সভাপতি ও সম্পাদকগণ একত্রে বসে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করবেন। এরপর গত ৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ৬ জন সভাপতি ও ১১ জন সাধারণ সম্পাদকরা ফল ঘোষণার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে করণীয় ঠিক করতে বৈঠক করেন।
এরপর গত ৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের দেয়া এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৭ এপ্রিল দুপুরে সমিতির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, এএম আমিন উদ্দিন ও সাবেক সম্পাদক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী নির্বাচন সাব-কমিটির আহবায়ক এওয়াই মসিউজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গত ১৭ মার্চ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাকালে সৃষ্ট অনাকাংখিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। সেই সাথে ফলাফল ঘোষণা সংক্রান্ত বাকী কাজ সম্পন্ন করার জন্য তাকে অনুরোধ জানান। এই প্রেক্ষিতে অ্যাডভোকেট এওয়াই মসিউজ্জামান শীঘ্রই ফলাফল ঘোষণার বাকি কাজ সম্পন্ন করতে সম্মত হন।’
তবে এরপর আনুষ্ঠানিক কোন ফল ঘোষণা ছাড়াই ১২ এপ্রিল রাতে ফেসবুকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সমর্থিত আইনজীবীরা বিভিন্ন পদে নেমপ্লেট লাগানের ছবি পোস্ট করেন। যেখানে ‘নির্বাচিত’ বলে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানো হয়। নেমপ্লেট লাগানোর বিষয়ে জানতে চাইলে সেদিন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা হয়ত হয়নি, তবে ওইদিন গণনার পর ফলাফল তো সবারই জানা। আর বিগত কমিটি গত বছরের ১১ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করে সে হিসেবেই গতকাল ১২ এপ্রিল অনেকে নেমপ্লেট লাগিয়ে দায়িত্ব শুরু করেছে। আর আমি তো আগে থেকেই আছি।’
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাদা প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী আবদুন নূর দুলাল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের প্যানেলের সভাপতি ও সহ-সভাপতি প্রার্থীদের সাথে আমার কথা হয়েছে। তারা আমাকে বলেছে তাদের নামের নেমপ্লেট লাগানের বিষয়ে তারা নিজেরাই কিছু জানেন না। এমনকি এবিষয়ে তাদের থেকে কোন সম্মতিও নেয়া হয়নি। আমরা এর বিরুদ্ধে অবশ্যই আইন মেনেই পদক্ষেপ নিবো। ‘ফ্রেশ কাউন্টিং’ হয়েই ফল ঘোষণা হতে হবে।’
এরপর ১৩ এপ্রিল সে সব নেমপ্লেট তুলে ফেলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা। এনিয়ে সেদিন দুপক্ষের মধ্যে তুমুল বাগবিতণ্ডা ও হট্টগোল হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এবারের নির্বাচনে কার্যনির্বাহী কমিটির ১৪টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৩৩ জন। আর মোট ভোটার ছিল ৮ হাজার ৬২৩ জন।