দারিদ্র্য পেছনে ফেলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অর্জন এখন রীতিমতো ঈর্ষনীয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন খাতে পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশ থেকেই বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। সরকারের নানামুখী জনউদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনার কারণেই বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমে আসছে। দারিদ্র্যের হার ২০০০ সালের ৪৮.৯ শতাংশ থেকে কমে ২০১৮ সালে ২৩ শতাংশ হয়েছে এবং এই সময়ে চরম দারিদ্র্যের হার ৩৪.৩ শতাংশ থেকে কমে ১২.৯ শতাংশ হয়েছে।
বিগত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষণীয়। ২০০৯ অর্থবছরের ৫.০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ২০১৮ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ৭.৮৬ শতাংশে। বলা হচ্ছে এই সময়ে মাথাপিছু আয় বেড়ে ৭০৩ ডলার থেকে ১৭৫১ ডলার হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমে ১২.৩ শতাংশ থেকে ৫.৩৫ শতাংশ হয়েছে। তার মানে গেল বছর মানুষের মাথাপিছু প্রকৃত আয় বেড়েছে আড়াই শতাংশের মতো। মোট বিনিয়োগ বেড়েছে চারগুন। ভোগ বেড়েছে তিন গুন।
দেখা যাচ্ছে গত এক’শ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত হতে পেরেছিল। আর গত এক দশকে সেখানে বড় এক সাফল্য লক্ষ্যণীয়। বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষমতা এর তিনগুনেরও বেশি বেড়ে আঠারো হাজার মেগাওয়াটে হয়েছে। এই অংক দ্রুতই বেড়ে চলেছে। রপ্তানির হারও বেড়েছে। ১৫.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৬.৭ বিলিয়ন ডলারে (অর্থাৎ ২.৩৫ গুন)। আমদানি বেড়েছে ৩.১৮ গুন (২২.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫৪.৫ বিলিয়ন ডলার)। রেমিট্যান্স বেড়ে হয়েছে ৯.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৭.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩২.৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে (প্রায় সাড়ে চারগুন)।
উর্ধ্বগতির এই অর্থনীতির সাথে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অগ্রগতি যোগ করলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ইতিবাচক চেহারার সন্ধান মেলে। এর ফলে দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের হার যেমন কমেছে, তেমনি মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে অভাবনীয় হারে। গত এক বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ছয় মাস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর(বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী সর্বশেষ গত ২০১৭ সালে গড় আয়ু হয়েছে ৭২ বছর। এর আগে এটি ছিল ৭১ বছর ৬ মাস। সামাজিক অনেক সূচকে আমরা এখন ভারত, পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। অনেক অর্জনই আমাদের লক্ষণীয়। উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ডের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রশংসিত হচ্ছে সর্বত্র। তবে একথা সত্য যে উন্নয়নের এই দুর্বার অগ্রগতির মধ্যেও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যে নিপতিত রয়েছে। বিশেষ করে দেশের দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে এখনও দারিদ্র্যের হার বেশি। এছাড়া নগর দারিদ্র্যও সেভাবে কমে আসেনি। নগর দরিদ্ররা বহুবিধ অবহেলা-অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। তবে নগর নির্মাণ, নগরের সৌন্দর্য বর্ধন ও সুরক্ষা এবং নগর পরিচ্ছন্নতায় তাদের ভূমিকা অপরিসীম। গৃহকর্মসহ নগরবাসীর বিভিন্ন সেবাপ্রদান ও পরিচর্যায় তারা বড় ধরনের অবদান রেখে চলেছে। এছাড়াও গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ছোট-বড় কল-কারখানা ও অন্যান্য উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে বড় সংখ্যক নগরদরিদ্র জনগোষ্ঠী সরাসরি যুক্ত রয়েছে। যারা দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে।
নগরে বসবাসরত হতদরিদ্র মানুষের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ লক্ষ্যণীয়। বর্তমান পক্ষ থেকে বস্তিবাসীকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে অনেকগুলো পরিকল্পনাভিত্তিক উন্নয়ন কৌশলও প্রণয়ন করা হয়েছে। কম মূল্যে আবাসন তৈরি, খাদ্য চাহিদা পূরণে খোলাবাজারে চাল বিক্রি, পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, হতদরিদ্র ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভাতা সুবিধাদি প্রদান, বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, কর্মসংস্থান তৈরিতে দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান-এসব সুবিধাদি নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। একই সাথে রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বিভিন্ন এলাকার বস্তিতে প্রকল্পভিত্তিক কার্যক্রম।
নগরদরিদ্ররা হলো নগরে বসবাসরত নিম্ন আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন বস্তি, ঝুপড়িতে বসবাস করে। এছাড়াও নগরদরিদ্রদের আরেকটি বড় অংশ ভাসমান ছিন্নমূল পথবাসী। যাদের কোনো ধরনের স্থায়ী-অস্থায়ী বা সুনির্দিষ্ট আশ্রয় বা ঠিকানা নেই। নগরীর বিভিন্ন রাস্তা-ঘাটে, ফুটপাতে, পরিত্যক্ত জায়গায়, রেলস্টেশনে, বাসটার্মিনালে, ফুটওভার ব্রিজে এদেরকে বসবাস করতে দেখা যায়। নগরদরিদ্রদের বড় অংশের বসবাস বিভিন্ন বস্তিতে। সরকারি সংজ্ঞা মতে, বস্তি হলো ৫ বা ততোধিক গুচ্ছখানা যা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সরকারি, আধাসরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে গড়ে ওঠে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যন ব্যুরোর বস্তিশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট বস্তিবাসী ও ভাসমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২২ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ জন-যা হচ্ছে দেশের মোট শহরে বসবাসরত অধিবাসীর ৬.৩৩ শতাংশ।
নগরদরিদ্ররা মূলত জীবিকা ও আশ্রয়ের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে বছরের পর বছর ধরে শহরে বসবাস করছে। বিশেষ করে নদী ভাঙন এবং অভাবগ্রস্ত অঞ্চল থেকেই বেশি হতদরিদ্র মানুষ নগরমুখী হয়েছে। নগরদরিদ্রদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। তবে নগরদরিদ্রদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অধিকার বঞ্চিত পথবাসী মানুষেরা। পথবাসীদের আদমশুমারীতে গণনা করা হলেও ঠিকানা নেই বিধায় তারা নাগরিক হিসাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত। তাদেরকে জাতীয় পরিচয় দেওয়া হয় না। এমনকি জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহে তারা ব্যর্থ। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীও তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা ২০১২ অত্যন্ত বাস্তবসম্মত বলে বিবেচিত। অথচ এই নীতিপত্রে বস্তিবাসীদের সম্পর্কে আলোকপাত করা হলেও পথবাসীরা অনুল্লেখ্য রয়ে গেছে। নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় বস্তিবাসীদের জন্য উদ্যোগ থাকলেও পথবাসীদের সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বলা হয়েছে চালচুলাহীন নিঃস্ব মানুষ। তাদের জন্য যৎসামান্য যে উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে তার বাস্তবায়ন কৌশল কী তার কোন বর্ণনা নেই নগর পরিকল্পনায়। একই অবস্থা জাতীয় শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও। সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য শিক্ষা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই পথবাসীরা উপেক্ষিত। সম্ভবত কর্তৃপক্ষ পথবাসীদের সম্পর্কে অবহিত নন অথবা এদেরকে নাগরিক হিসেবে গণ্য করছে না।সংঘবদ্ধ, বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্তভাবে নগরের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী নগর হতদরিদ্রদের দুঃখ-বঞ্চনার শেষ নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়সহ যে সব মৌলিক অধিকার অনুসৃত আছে নগরদরিদ্রদের বড় অংশই তা থেকে বঞ্চিত। বিভিন্ন বস্তি-ঝুপড়িতে এখনও বিদ্যুৎ, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং যাতায়াত ব্যবস্থার সংকট প্রকট। ফলে অধিকার বঞ্চিত বস্তিবাসীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। প্রয়োজনীয় টয়লেট সুবিধাদির ব্যবস্থা না থাকায় অনেক বস্তির নারীরাই বিপদাপন্ন অবস্থায় পতিত। এসবের বাইরে এখনও বস্তির হতদরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য সেবা সুনিশ্চিত হয়নি। গ্রামের তুলনায় সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাদিও বস্তিবাসীর জন্য অপ্রতুল। নগরদরিদ্রদের আরেক বড় বঞ্চনা হলো উচ্ছেদ ও হয়রানি। নানা সময়ে, নানান অজুহাতে তাদেরকে অমানবিক উচ্ছেদের শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়।
বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও নগরদারিদ্র্য সেভাবে কমে আসছে না। বরং কাজ ও আশ্রয়ের সন্ধানে প্রতিবছর শহরমুখী হচ্ছে, শহরের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে। শহর ছেড়ে দরিদ্র মানুষেরা যে গ্রামে চলে যাচ্ছে এরকম নজীর নেই বলেই চলে। যদিও গ্রামে দারিদ্র্য কমাতে সরকারের একাধিক শক্তপোক্ত কর্মসূচি চালু হয়েছে। আসলে নগরদারিদ্র্য কমিয়ে আনার জন্য এখনই খুব ভালো যুতসই কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। সেটা করা না গেলে আমাদের অনেক অর্জনই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
( এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)