রাজধানীর কয়েকটি পার্কের গাছের পাতায় জমে থাকা ধূলিকণার পরিমাণ নিয়ে এক গবেষণা ফলাফল বলছে, এসব গাছ মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধূলিকণা ধারণ করে। যা সার্বিক পরিবেশের ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি খুবই উদ্বেগের, সংশ্লিষ্টরা এখনই দায়িত্বশীল না হলে দূষিত পরিবেশে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। এমনকি ধীরে ধীরে এসব গাছ মরে যাবে।
তারা মনে করেন, ধূলিকণার উৎস, পুরনো বাস-ট্রাক চলাচল, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ইটভাটা, শিল্প কারখানার বর্জ্য এসব নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে রাজধানীর গাছ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) পরিচালিত ‘ঢাকা শহরে গাছের পাতায় ধূলিকণা জমার সামগ্রিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক একটি গবেষণায় শহরের ৪টি পার্ক; গুলিস্তান পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান, রমনা পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিভিন্ন প্রজাতির ৭৭টি গাছের পাতা নিয়ে কাজ করা হয়।
নমুনা হিসাবে রাস্তা সংলগ্ন পার্ক প্রাচীরের ভিতরের গাছের পাতা ও রাস্তা থেকে প্রায় ১০০ মিটার ভিতরে অবস্থিত গাছের পাতা সংগ্রহ করা হয়। পাতাগুলো ৯ ফেব্রুয়ারি নমুনার জন্য প্রস্তত করে রাখা হয় এবং ৭২ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রিত ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংগ্রহ করা হয়।
গবেষকরা বলছেন, ঢাকার গাছে প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলা জমে। সেই হিসাবে মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধূলা জমার হিসাব পেয়েছেন তারা।
ঢাকা শহরে ৯৬.৪৮ বর্গ কিলোমিটার আচ্ছাদিত বৃক্ষরাজি প্রতি ৩ দিনে নূন্যতম প্রায় এক হাজার ৩১০ মেট্রিক টন ধূলাবালি ধারণ করে আসছে বলে ধারণা করা যায় অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৪৩৬.৭ মেট্রিক টন ধূলাবালি এবং মাসে প্রায় ১৩ হাজার ১০১ মেট্রিক টন ঢাকা শহরের গাছের ওপর জমা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি পার্কে ধূলিকণা বৃদ্ধির হার আরেকটির তুলনায় প্রায় ২ গুণ।
ধূলিকণার উপস্থিতি যথাক্রমে গুলিস্তান পার্কে প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ২৭.৯৩ মাইক্রোগ্রাম, চন্দ্রিমা উদ্যানে প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ১১.৩৬ মাইক্রোগ্রাম, রমনা পার্কে প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ৮.৯৯ মাইক্রোগ্রাম এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ৪.৮৫ মাইক্রোগ্রাম।
অর্থাৎ সবচেয়ে ধূলিকণা প্রবণ পার্ক হলো গুলিস্তান পার্ক (প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ২৭.৯৩ মাইক্রোগ্রাম) এবং তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন (প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ৪.৮৫ মাইক্রোগ্রাম)
গবেষণায় আরও দেখা যায়, রমনা পার্ক ছাড়া বাকি ৩টি পার্কে রাস্তা হতে প্রায় ১০০ মিটার ভিতরে গাছের পাতায় ধূলিকণার উপস্থিতি কম ছিল এবং রাস্তা সংলগ্ন গাছের পাতায় উপস্থিতি বেশী ছিল। কিন্তু রমনা পার্কের ভিতরের গাছের পাতায়ও ধূলিকণার উপস্থিতি বেশী পাওয়া যায়।
নমুনার মধ্যে উল্লখযোগ্য কয়েকটি প্রজাতি পাতায় গড়ে ধূলিকণার পরিমাণ আম পাতায় প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ৩৫.৭৭ মাইক্রোগ্রাম, দেবদারু গাছের পাতায় প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ১৮.৬৯ মাইক্রোগ্রাম, কাঁঠাল পাতায় প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ৮.৮৪ মাইক্রোগ্রাম, মেহগনি গাছের পাতায় প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ৭.৭০ মাইক্রোগ্রাম, বকুল পাতায় প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ৩.০৬ মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ ধূলিকণার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।
হিসাব করে দেখা যায় যে, ৭২ ঘণ্টায় গড়ে ধূলিকণা জমার পরিমাণ ছিল প্রতি বর্গ মিলিমিটারে ১৩.৫৯ মাইক্রোগ্রাম এবং ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ধূলিকণা জমার পরিমাণ বর্গ মিলিমিটারে ৪.৫৩ মাইক্রোগ্রাম।
ক্যাপসের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের যেসব গাছপালা রয়েছে তার মধ্যে বিশেষ করে দেবদারু, আম ও জাম এর দূষণ সহ্য ক্ষমতা অন্যান্য গাছের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আবার টগর, বাগানবিলাস ও কদম গাছের দূষণ সহ্য ক্ষমতা অনেকাংশে কম।
গবেষক দলের প্রধান ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এই ধূলাবালি পরবর্তী সময়ে বাতাসের সাথে কম বেশী মিশে গিয়ে ঢাকার বায়ুমানকে খারাপ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। আবার ধুলাবালির কারণে গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া, বৃদ্ধি ও ফুল-ফল প্রদান প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে। সুতরাং ঢাকা শহরে বৃক্ষরোপন করার সময় দূষণের বিষয়টা বিবেচনা রাখা অত্যন্ত জরুরী।
তিনি বলেন, যেসব বৃক্ষ দূষণের ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বা দূষণ সহ্য ক্ষমতা বেশি সেইসব বৃক্ষরোপণে কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ধুলিকণা জমার প্রতিক্রিয়ায় অক্সিজেনের ঘাটতি হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘অবশ্যই অক্সিজেনের ঘাটতি হবে। গাছ তার পাতার মাধ্যমে সূর্যের আলো ব্যবহার করে তার খাদ্য ক্লোরফিল উৎপন্ন করে এবং উপজাত হিসেবে পানি দেয়। অক্সিজেন এবং পানি দুটোই কিন্তু গাছ থেকে আসে।’
“এখন আমরা যদি আমাদের ঢাকা শহরের গাছের পাতাগুলি ধূলা দিয়ে বন্ধ করে দেই তাহলে গাছের নিজস্ব যে খাদ্য উৎপাদান পদ্ধতি বা সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটবে। এরফলে গাছগুলোর বৃদ্ধি ভালো হবে না, যদি ফলগাছ থাকে তাহলে রেণুর ভেতরে ধূলাবালি পড়লে পরাগায়নের জন্য মাছিগুলো আসবে না পাশাপাশি পত্ররন্ধ বন্ধ হয়ে যাবে।”
তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও ধানমন্ডির কয়েক জায়গায় গতবছর সামান্য বাতাসে পড়ে গেছে অনেক বড় বৃক্ষ। কারণ গাছগুলি ঠিকভাবে সালোকসংশ্লেষণ করতে পারছিল না।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এ চেয়ারম্যান বলেন, গত বছর ধানমন্ডি লেকের পাশে একটি গাছ পড়ে একজন সরকারী কর্মকর্তা মারা যায়, আমি সেখানে গাছটি দেখতে গিয়ে দেখলাম। গাছটির পাতাগুলো ব্যাপক দূষিত ছিল, গোড়াসহ উঠে গিয়েছিল। কারণ গাছের গোড়া পচা ছিল।
তিনি বলেন, গাছের বৃদ্ধির জন্য দরকার বিশুদ্ধ পরিবেশ দরকার। আমরা প্রতিকার দূষিত আবহাওয়ার জন্য ঢাকার গাছে বৃদ্ধি ঠিকমতো হচ্ছে না।
প্রতিকার জানতে চাইলে ক্যাপসের এ প্রতিষ্ঠাতা বললেন, প্রথমত নগরীতে যেখানে সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি না করে সিটি করপোরেশন থেকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানদের নিয়ম মাফিক কাজ করতে বলা যেতে পারে। রাজধানী ও আশপাশের যে ইটভাটা আছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে পাশাপাশি শিল্প কারখানার বর্জ্যগুলোও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রাজধানীর ৩০টির বেশি জায়গায় আবর্জনা ড্যাম্পিং করা হয়। সেগুলোও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে।
রাজধানীর গাছ বাঁচাতে ধুলার উৎপত্তি বন্ধ করতে হবে জানিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমাদের জ্বালানি তেল খুবই নিম্ন মানের। তেলের মধ্যে আঠালো পদার্থ বেশি থাকে। ধূলা আর এই আঠালো পদার্থ গাছের পাতায় বেশি পরিমাণে লেগে থাকে।
প্রতিকারের জন্য অবশ্যই পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা দরকার জানিয়ে তিনি বললেন, যেসব জায়গায় গাছে নিচে থেকে পানি স্প্রে করা সম্ভব, সেখানে স্প্রে করা যেতে পারে। এছাড়াও গাড়ির জ্বালানি উন্নত মানের করা দরকার।
গুলিস্তান পার্ক ও রমনা পার্কের গাছের পরিচর্যার বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. জাহিদ হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: পার্কে পানি ছিটানোর দায়িত্ব আমাদের মধ্যে পড়ে না, এটা চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর করতে পারে। আমরা রাস্তায় পানি ছিটাই যেন ধূলা না উড়ে।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক (প্রচার) সমর কৃষ্ণ দাস চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বিষয়টা কখনোই পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে পড়ে না, এটা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাজ।