অমর প্রেমের গল্প খুঁজতে আমরা উপন্যাস চলচ্চিত্রের দারস্থ হই। অথচ আমাদের হাতের নাগালে রয়েছে জীবন্ত প্রেমের উপন্যাস। জীবন্ত প্রেমের চলচ্চিত্র।
পর্যটন জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ। ব্রিটিশ আমলে (বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে) কলকাতা থেকে টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন পুলিশ কর্মকর্তা
ধীরাজ চট্টোপাধ্যায় । চেহারায় কবি কবি ভাব । ঘনবসতির কলকাতা থেকে নির্জন টেকনাফে এসে মন খারাপ ধীরাজের। তার সময় কাটে সাগর দেখে। পাহাড় দেখে। সবুজ বন দেখে।
একদিন খুব ভোরে তরুণীদের কথার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। জানালা খুলে দেখেন, স্থানীয় মগ আদিবাসী মেয়েরা পানি নিতে এসেছে থানার সামনের কূপ থেকে। সে সময় পুরো টেকনাফে একটাই কূপ ছিল। সূর্য ওঠার আগে স্থানীয় মেয়েরা কূপ থেকে পানি নিত। এরপর ধীরাজ রুটিন করে ভোরের আগে ঘুম থেকে উঠতেন। থানার বারান্দায় চেয়ার পেতে দেখতেন মেয়েদের পানি তোলা। কাঁকে কলসি নিয়ে আঁকা বাকা পথ বেয়ে হেঁটে যাওয়া।
একদিন ভোরের আবছা আলোয় থমকে গেলেন পুলিশ অফিসার। একটি মুখের উপর আটকে গেল চোখ। কবি জয় গোস্বামী এমন মূহুর্তকে তার ভাষায় বর্ননা করেছেন-
‘একজনকে মনে হলো ওরই মধ্যে অন্যরকম
এগিয়ে গিয়ে বলি তাকেই
তুমি কি সেই মেঘবালিকা, তুমি কি সেই?’
দুজনের চোখাচোখি হলো। কিছুক্ষণ থমকে থেকে দুজনেই সলজ্জ হাসিতে মুখ লুকিয়ে নিলেন। কারো কিছু বলতে হলো না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। ‘তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’।
পুলিশ অফিসার ধীরাজ চট্টপাধ্যায় স্থানীয় মগ জমিদারকন্যা মাথিনের প্রেমে ডুবে গেলেন। মাথিনও হাবুডুবু খাচ্ছেন ধীরাজের প্রেমে। সেদিনের পর থেকে মাথিন সবার আগে ঘুম থেকে উঠে কলসি নিয়ে চলে যেতেন কূপের ধারে। থানার উঠানে সারারাত পায়চারি করা ধীরাজ মাথিনের দিকে চেয়ে থাকতেন। মাথিন ধীরাজের দিকে।
প্রেম আর আগুন নাকি লুকিয়ে রাখা যায় না। মাথিন-ধীরাজের ক্ষেত্রেও তাই হলো। এককান দুইকান করে তাদের প্রেমের খবর চলে গেল মাথিনের বাবা জমিদার ওয়ানথিংয়ের কানে। জমিদার নিজের মেয়েকে ভিন্ন জাতির সাথে বিয়ে দেবেন না। কিন্তু মাথিনের প্রবল ভালোবাসার কাছে হেরে গেলেন। মেনে নিলেন তাদের ভালোবাসাকে। ছোট্ট মগ পল্লীতে বসন্তের বাতাস বইতে শুরু করল। পুলিশ অফিসার তাদের জামাইবাবু হচ্ছেন। মগ আদিবাসিদের জীবনে এরচে সুখের ঘটনা আগে ঘটেনি।
তাদের বিয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন। এমন সময় খবর আসে ধীরাজের বাবা গুরুতর অসুস্থ। দ্রুত কলকাতা যেতে বলা হয়। ধীরাজের মন খারাপ। একদিকে বাবা, আরেকদিকে প্রিয়তমা। মাথিনের মন বেশি খারাপ। প্রেমিক ধীরাজকে যেতে সায় দেয় না প্রেমিকার মন। নিরুপায়্ হয়ে মাথিনকে রেখে অসুস্থ বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতায় চলে যান ধীরাজ।
এরপর তিনি আর ফেরেননি। কী হয়েছিল ধীরাজের? তা জানতে পারেনি মাথিন। অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারেননি মগ জমিদার।
প্রেমের শোকে অর্ধাহারে অনাহারে কাটতে থাকে মাথিনের দিনরাত। চেয়ে থাকেন ধীরাজের যাওয়ার পথে। আনমনে বসে থাকেন কূপের পাশে। ভালোবাসা হারানোর বেদনায় কাতর মাথিন ধীরাজের অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে এক সময় না ফেরার পথে পাড়ি জমান। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জানিয়ে গেলেন সত্যিকারের ভালোবাসার স্বরুপ।
ধীরাজ চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালে লাহোরের ইউনিক পাবলিকেশন্স থেকে ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ নামে আত্মজীবনীমূলক বই লেখেন। সে বইয়ে লেখেন ধীরাজ-মাথিনের বিয়োগান্ত প্রেমের উপখ্যান।
১৯৮৪ সালে এই কূপের নামকরণ করা হয় মাথিনের কূপ। যা এখনো টেকনাফ থানায় সংরক্ষিত আছে। ভালোবাসা দিবসে অমর প্রেমের অন্যতম নিদর্শন এই মাথিনের কূপ দেখতে কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় ভিড় জমান দর্শনার্থীরা। কূপের সামনে দেয়ালে লেখা, তাদের প্রেমের গল্প পড়ে মুগ্ধ হন। আবার অনেকেই বিয়োগান্তক এ ভালোবাসার গল্প পড়ে মাথিনের ব্যথায় ব্যথিত হন।