বিজয়ের দিনে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আজকে লিখতে বসেছি। বাংলাদেশে যে জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হয় তার প্রত্যেকটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে থাকে। জাতীয় দিবসগুলোর গুরুত্ব ও মাহাত্ন্য অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়ে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয় দিবস পালনের নিমিত্তে অনুষ্ঠান উদযাপন করে থাকে। জাতীয় দিবসের মর্মার্থ বিবেচনায় নিয়ে মিডিয়াগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে জাতীয় বীরদের কৃতিত্বের নমুনায়নের মাধ্যমে জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে।
জাতীয় দিবস পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সার্বিক দিক সম্বন্ধে বর্তমান প্রজন্মকে জানানোর পাশাপাশি দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি কৃষ্টি কালচারের পরিচায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে। বর্তমান প্রজন্মের আমরা যারা আছি তাদের পক্ষে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কেননা, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস একটি জাতির ইতিহাসে বারবার আসে না। তাহলে আমাদের ঐ সব স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বীর সেনানীদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের সহিত স্মরণ করতে হবে এবং দেশপ্রেমের মন্ত্রমুগ্ধে উজ্জীবিত হয়ে সত্যিকার দেশপ্রেমিক হয়ে দেশসেবায় আত্ননিয়োগ করতে হবে। অন্যথায়, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
১৪ ডিসেম্বর মহান বুদ্ধিজীবী দিবসের পালনের সচিত্র মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী দেখেছে। আমাদের প্রথমেই অনুধাবন করতে হবে-১৪ ডিসেম্বর আমাদের বাঙালি জাতির জীবনে কেন ঘটেছিল এবং এর ভয়াবহতায় বাংলাদেশের কি কি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সে বিষয়ের মর্মার্থ অনুধাবন করে বুদ্ধিজীবী চত্ত্বরে আমাদের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। দিবসের প্রতিপাদ্য না জেনে দিবস উদযাপনে ব্রতী হলে হিতে বিপরীত হয়। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যখন বুঝতে পেরেছিল বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত ঠিক তখন তারা দেশ গঠনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে তাদেরকে বিশেষ করে শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবী ৪২ জন, অন্যান্য ১৬ জনকে টার্গেট করে হত্যা করে এ দেশীয় দোসরদের চক্রান্তে।
একবার ভাবা যায়, প্রথিতযশা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও অন্যান্য পেশায় যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সমুজ্জ্বল ব্যক্তিগণকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে মেধাশূণ্য করার জটিল সমীকরণ পূর্ণ করতে সমর্থ হয় এ দেশীয় দেশদ্রোহীদের সহযোগিতায়। কেননা, যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশকে বিনির্মাণের জন্য যাদের মেধা, শ্রম ও সাংগঠনিক সামর্থের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী তাদেরকে ক্রমে ক্রমে হত্যা করে পাকিস্তানিরা তাদের মনোবাসনা পূরণ করেছিল।
পূর্বের ইতিহাস আমাদের প্রায় সকলেরই জানা। আমাদের যেহেতু স্বাধিকার আন্দোলনের সুযোগ নেই সেহেতু আমাদের করণীয় কি হতে পারে যার ভিত্তিতে আমরা দেশের জন্য কিছু করতে পারি। তার আগে বলে নেই, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের নিমিত্তে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে অনেককেই মুখে গগণবিদারী হাসি দিয়ে সেলফি তুলতে দেখা যায়। তারা নিমিষেই ভুলে বসেন কোন অনুষ্ঠানে তারা এসেছে, কেন এসেছে? আমি তাদের প্রতি ধিক্কার জানাই, আপনার তো অনুষ্ঠানে আসার দরকার নাই। আপনাকে অনুষ্ঠানে আসতে বলেছে কে? আর হ্যাঁ দেশপ্রেম প্রত্যয়টি অনুধাবনের, ভাবাবেগের যা হৃদয় দিয়ে অবগাহন করতে হয়। আপনারা যারা অনুষ্ঠানে এসে অনুষ্ঠানের তাৎপর্যকে পালন করতে অপারগ হোন তাদের অনুষ্ঠানে না আসাই শ্রেয়। আর অনুষ্ঠানে এসে এহেন বেয়াদবির সমুচিত জবাব দেওয়া উচিত এবং রাষ্রেগার সেটা করা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করি।
বর্তমান প্রজন্মের দেশপ্রেমে ব্রতী হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা করণীয় বলে মনে করি।
কেননা, দেশপ্রেমে ব্রতী হওয়া ব্যতিরেকে দেশটির মানবিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। নতুন প্রজন্মের সারথিরা দেশকে পথ দেখাবে, মানব উন্নয়নের গল্প শোনাবে, সত্য মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ করে উন্নত বাংলাদেশের পথে প্রতিনিয়ত ধাবমান হবে। সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎসাহস থাকতে হবে। সমাজে সংঘটিত যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস দেখাতে হবে এবং কাউকে না কাউকে কিন্তু প্রতিবাদ শুরু করতে হবে। সমসাময়িক সময়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তনের রূপরেখা আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। কাজেই, অন্যায় তো আমার সাথে হচ্ছে না এমনটি ভেবে বসে না থেকে যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখাতে হবে। সর্বোপরী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মানসিকতা বপন করতে হবে। দেশের যে কোন সঙ্কটময় মূহুর্তে সকলকে একযোগে সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে। মানবিক বাংলাদেশের চিত্র আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি এবং প্রচলিত ধারাটি অব্যাহত রাখতে হবে।
রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত যে কোন দায়িত্ব যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। যেমন; যারা শিক্ষকতা পেশায় জড়িত-একাডেমিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার পাশাপাশি প্রশাসনিক কোন দায়িত্ব থাকলেও সেটা সুচারুরূপে পালন করা উচিত। উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে গবেষণার মাধ্যমে নতুন তথ্য বের করে নিয়ে আসা যার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র পলিসি লেভেলে গবেষণার ফলাফল প্রয়োগ করে উপকৃত হতে পারে। কেউ যদি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পারে তাহলে তিনি অবশ্যই সুনাগরিক নয়। প্রত্যেককেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিয়ে ভূমিকা পালন করা উচিত।
দেশবিরোধী চক্রকে যে কোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বদেশের মর্যাদাকে যে কোন কিছুর বিনিময়ে সমুন্নত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশটি আমাদের সবার, যে কোন সরকারি সম্পদের দাবিদার আমি, আপনি, সবাই। কাজেই, সকলেই সরকারি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করবো এবং সরকারি সম্পদের অপচয় রোধে সম্মিলিত প্রয়াস দরকার আর সে ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের সারথিরা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
পরিশেষে দেশপ্রেমে যারা এখনো ব্রতী হয়ে দেশের তরে কাজ করার মানসিকতা বপন করতে পারেনি তাদের প্রতি ধিক্কার জানাই বিজয়ের মাসে। আসুন সকলেই দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রয়াসে মনোনিবেশ করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)