চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ধানের দাম নিয়ে কৃষকের ক্ষোভ ও একজন শেরে বাংলা ফজলুল হকের কীর্তি

প্রান্তিক চাষিদের উৎপাদিত ধানের দাম বাড়াতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও তার প্রতিফলন বাজারে পড়েনি বলে স্বীকার করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। সম্প্রতি তিনি জাতীয় সংসদে বলেছেন, “কৃষকেরা ধান বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষক প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।”

কৃষিমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে তিনি বাস্তব অবস্থাটা স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো ধানের দাম বাড়াতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও তার প্রতিফলন বাজারে পড়েছে না কেন? কোথায় গলদ? বর্তমান সরকার ধারবাহিকভাবে ক্ষমতায় আছে প্রায় এক দশক হতে চলল। তারপরও কেন টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না? প্রতিবছরই কেন একই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে? সরকার প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে কয়েক বছর হলো। কিন্তু অভিযোগ আছে, সে তালিকায় প্রকৃত কৃষকদের নাম থাকছে না। সেখানে থাকছে কেবল দলের লোকজনের নাম। যারা জীবনে কখনো কাঁচা ধান হাতে নিয়ে দেখেনি। তাদের হাতে থাকছে ১০০ মণ ধান গোডাউনে জমা দেবার রশিদ। আর এই রশিদ বলে কৃষক না হয়েও এইসব ‘দালালচক্র’ ৪শ টাকা দরে ধান কৃষকদের কাছ থেকে কিনে ১০০০ টাকা দরে সরকারের গোডাউনে জমা দেয়। এসব ‘মারপ্যাঁচ’ মন্ত্রীরা যে জানেনা তা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো ‘নষ্টচক্র’ তারা ভাঙ্গতে পারেন না। সেই হিম্মত তাদের থাকে না।

কৃষকের স্বার্থের কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ছে শেরে বাংলা ফজলুল হকের একটি ঘটনা। এখানে বলে রাখা সঙ্গত যে, আমরা নেতানেত্রীদের জীবন-কাহিনী পাঠ করি না। তাদের জীবনের মহৎ দিকগুলো নিয়ে কখনই আলোচনা করি না। কেবল ব্যস্ত থাকি কার কি খুঁত আছে, সেটা তুরে ধরতে। অথচ আমাদের এ অঞ্চলে অনেক নেতা রয়েছেন যাদের জীবন আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয়। আমরা আজ তেমন একজন নেতার একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করব।

সালটা ছিল ১৯০১। আঠাশ বছর বয়সী এক সুঠাম যুবক কলকাতা থেকে বরিশালের চাখার গ্রামের দিকে চলেছেন। সেখানেই তাঁদের বেশ কয়েক পুরুষের বসবাস। যুবকটি এর আগে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে একইসঙ্গে তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের পাশাপাশি আইনও পাশ করেছেন। কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক হিসেবে কাজ করলেও অল্পদিনের মধ্যেই তা ছেড়ে আইন ব্যবসাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জুনিয়র হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন। অল্পস্বল্প সুনামও অর্জন করেছেন।

সেদিন সেই ঝকঝকে যুবকটি বরিশালের দেহেরগতিতে সবে খেয়া পার হয়েছেন। ওখান থেকে তাঁর গ্রামের বাড়ি খুব দূরে নয়। অনেকদিন বাদে ফিরছেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হবে। উৎফুল্ল মন। খেয়া নৌকা থেকে নেমে সামান্য এগতেই একটা শিশুকণ্ঠে তীব্র কান্নার আওয়াজ কানে এলো। তাকিয়ে দেখলেন, কিছুটা দূরে নদীতীরের একটা কুঁড়েঘরের সামনে ছোটখাটো ভিড়। মনে হল শিশুর কান্নার শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। কৌতূহলী যুবক জোরে পা চালিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই কুঁড়েঘরের সামনে পৌঁছে গেলেন। দেখলেন, গরিব পরিবারের সংসারের যা কিছু সম্বল—সামান্য টিনের তোরঙ্গ থেকে শুরু করে তৈজসপত্র, থালা বাসন, ঘটি বাটি, বালতি কড়াই, লাঙল, কোদাল, কাস্তে প্রভৃতি সমস্ত কিছু উঠোনের এক পাশে জড়ো করা রয়েছে। আর, সাত-আট বছরের একটি শিশু মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার খালি গা। তবে দু’হাত দিয়ে শক্ত করে বুকে চেপে রেখেছে ছোট্ট একটা কাঁসার থালা। ওই থালাটি কেড়ে নিতে থানার পেয়াদা জোরাজুরি করতে গেলেই সে প্রতিবাদ জানিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। ওই থালাটুকু না নেওয়ার কাতর আর্জি জানিয়ে শিশুটির বাবা-মা পেয়াদাকে অনুনয় বিনয় করছে। কিন্তু পেয়াদার হম্বিতম্বি থামছে না। ওদের ঘিরে জড়ো হওয়া জনতা নীরবে ঘটনাটি উপভোগ করছে। শহুরে পোশাক-আশাক পরিহিত আগন্তুক যুবককে দেখে শিশুটির আশঙ্কা যেন আরও বেড়ে গেল। সে আরও তীব্রস্বরে কাঁদতে লাগল। জনতাও খানিকটা সরে দাঁড়াল। পেয়াদাকে প্রশ্ন করে যুবকটি জানতে পারলেন, কুটিরের বাসিন্দা লোকটি এক গরিব চাষি। দেনার দায়ে তার সর্বস্ব ক্রোক হয়েছে। সেগুলি নিতেই লোকজনসহ পেয়াদা এসেছে। চাষির ঘরের বাকি সমস্ত সামগ্রী বিনা বাধায় হস্তগত হয়েছে। বাকি কেবল ওই ছোট্ট থালাটি। শিশুটি ওই ছোট্ট কাঁসার থালাটি কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নয়। কারণ, ওই থালাতেই সে রোজ খায়।

শিশুটির কান্না যুবকের হৃদয়ে অদ্ভুত মোচড় দিল। তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের পকেট থেকে চাষির সেই ঋণের টাকা মিটিয়ে দিলেন। পেয়াদার হম্বিতম্বি বন্ধ হল। আর, প্রিয় থালাটি কাছে রাখতে পেয়ে শিশুর মুখে হাসি ফুটল। গ্রামের বাড়িতে ফিরলেও নদীতীরের ঘটনাটি অস্থির করে তুলেছিল চাখারের সেই যুবকটিকে। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যে ভাবেই হোক, বাংলার গরিব কৃষকদের তিনি মহাজনি ঋণের ফাঁস থেকে মুক্ত করবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বরিশাল শহরে গিয়ে সটান দেখা করলেন আধুনিক বরিশালের নির্মাতা অশ্বিনীকুমার দত্তের সঙ্গে। অশ্বিনীকুমার সেসময় ওই এলাকার অত্যন্ত প্রভাবশালী ও সম্মাননীয় কংগ্রেস নেতা। বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান। যুবকটি নিজের পরিচয়সহ কয়েকদিন আগের ঘটনাটি বিবৃত করলেন। বললেন, গরিব চাষির দুঃখ ঘোচানোর কিছু আমি কিছু করতে চাই। কোন পথে যাব, উপদেশ দিন। অশ্বিনীকুমার বললেন, রাজনৈতিক নেতারাই পারেন এমন সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে। তাঁরাই আইনসভার সদস্য হন। আইন কানুন বানান। তোমার লক্ষ্যপূরণের জন্য রাজনীতির ময়দানই সঠিক পথ। প্রবীণ নেতার বক্তব্য যুবককে প্রচণ্ড প্রভাবিত করল। তিনি রাজি হলেন রাজনীতিতে নামতে। অশ্বিনীকুমার দত্তের আশীর্বাদে অল্পদিনের মধ্যেই যুবকটির জীবনের মোড় ঘুরে গেল। ভোটে দাঁড়িয়ে বরিশাল পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হলেন। কিছুদিনের মধ্যে জেলা বোর্ডের সদস্যও। আরও পরে নিজের প্রতিজ্ঞাপূরণের লক্ষ্যে সেদিনের যুবকটি একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন। নাম কৃষক প্রজা পার্টি। দলটির নির্বাচনী প্রতীক ছিল লাঙল। দলের প্রধান স্লোগান—‘লাঙল যার, জমি তার, ঘাম যার, দাম তার’। অল্পদিনের মধ্যেই কৃষিপ্রধান বাংলায় ওই দলটি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি একবার কলকাতার মেয়র ও পরে ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (সেসময় মুখ্যমন্ত্রী পদটি ওইনামেই অভিহিত হতো) পদে আসীন হন। প্রধানমন্ত্রী পদে বসেই প্রথম যে উল্লেখযোগ্য কাজটি করেছিলেন, তা হল ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন। এই বোর্ডের মাধ্যমেই দীর্ঘকালীন মহাজনি ঋণের ফাঁস থেকে বাংলার গরিব কৃষকদের মুক্তির দিশা মেলে।

এই মানুষটির নাম এ কে ফজলুল হক। বাংলার বাঘ আশুতোষের প্রিয় এই ছাত্র নিজেও একসময় ‘শের এ বাংলা’ অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন। শোনা যায়, ‘প্রিয় স্যার’ আশুতোষের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রথমবার মন্ত্রী হওয়ার পিছনে ফজলুল হকের বিশেষ ভূমিকা ছিল। পরবর্তীকালে ভিন্ন দুই দলের নেতা হিসেবে দু’জনে বাংলায় যৌথ সরকার গড়েছিলেন যা শ্যামা-হক সরকার বলে পরিচিতি লাভ করেছিল।

সেই ১৯০১ সালের পর শতাধিক বছর কেটে গিয়েছে। দুদফা দেশ স্বাধীন হয়েছে। কতো কতো ‘কৃষকবান্ধব’ সরকার ক্ষমতায় এসেছে-গেছে। কিন্তু কৃষকের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এমনকি তাদের ঋণের ফাঁস থেকে আজও সত্যিকারের মুক্তি ঘটেনি।

দেনার দায় শোধ করতে এখনও কৃষকদের বিনিদ্ররাত কাটাতে হয়। ভোটের পর ভোট আসে। কৃষককে নিয়ে রাজনীতি হয়। একদল ক্ষমতায় আসে। আরেকদল ক্ষমতায় যাবার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালায়। কিন্তু কৃষককুল পুরনো তিমিরেই রয়ে যায়। কারণ, কৃষককে স্থায়ীভাবে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য যে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি এবং তা রূপায়ণে কঠোর নিষ্ঠা প্রয়োজন, তার অভাব রয়েই যায়। এর জন্য গভীর ভাবনা-চিন্তা প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রকৃত আন্তরিকতা।

সাধারণ কৃষকদের মধ্যে ঋণ বিতরণ, বন্যা-খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঋণমওকুফের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ শোধ না-করা, টাকা মেরে বিদেশ পালিয়ে যাওয়া ধনীরা দেশের শত্রুর পর্যায়েই পড়ে। তারা যদি সরকারের আনুকূল্য পায়, তবে কৃষক পাবে না কেন? কৃষকের ব্যাপারে দরকার মৌসুমের শুরুতে যথাসময়ে সহজ পথে ঋণ থেকে শুরু করে সুবিধাজনক মূল্যে চাষের উপকরণ জোগানো। পরবর্তী স্তরে সেচের সুবিধা, উৎপাদিত ফসল লাভজনক মূল্যে সহজে বিক্রির ব্যবস্থা আরও গুরুত্বপূর্ণ। আর, চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সঠিক চাষিটিই যাতে ক্ষতিপূরণ পান, সঠিক চাষিটির কাছ থেকেই যেন ন্যায্যমূল্যে ফসল কেনা হও-তাও সুনিশ্চিত করতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)