বাংলাদেশে ইদানিং ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। সমাজের নিম্নস্তর থেকে শুরু করে উপরিস্তর সব জায়গায় ধর্ষণ একটি ব্যাধিরূপে আর্বিভূত হয়েছে। পুঁজিরাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতির সঙ্গে ধর্ষণও ওতপ্রোতভাবেভাবে জড়িত। এটি একমাত্র নির্মূল অবস্থায় দেখেছিলাম আমরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে। এখন সেসবও অতীতের গল্প।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সম্প্রতি ঘটেছে এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এটিকে ধর্ষণ বললেও কম বলা হবে। এ ধরণের নারকীয় অত্যাচার মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ওই নারীর করুণ আর্তনাদ শুনে আসমান কেঁপে যাচ্ছে, কিন্তু রাষ্ট্রের পাষাণ মন অবিচল। গাড়ি চলছে, ঘোড়া চলছে, নানা রঙ ছড়াচ্ছে। বেগমগঞ্জের সেই নারী, সেই মা, সেই স্ত্রী নির্যাতকদের পায়ে–পায়ে ঘুরে যখন অসহায়ত্বের চিৎকার করছে পাড়া-প্রতিবেশী তখন দুয়ার আটকে চুপ! ফেসবুকে যখন ‘চ্যালেঞ্জিং টাইমসের’ সেল্ফিসহ কতরকম চ্যালেঞ্জের মচ্ছব, তখন হায়েনার দল নারীমাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে আর উল্লাস করছে। মরার পূর্বপর্যন্ত মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে। বাঁচার চেষ্টায় ওই নারী কী–না করে গেলেন কিন্তু বাঁচাবার কোনো হাত পাওয়া গেল না। আজ বেগমগঞ্জ, গতকাল সিলেট, তার আগে খাগড়াছড়ি, তার আগে খুলনা, তার আগে বগুড়া—কোথায় না?
বেগমগঞ্জের ঘটনায় সেটাই দেখা যায়। ৩২ দিন আগের ঘটনা তারা ভিডিও করে রেখেছিল এই উদ্দেশ্যে, ওই ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে ওই নারীকে দাসী বানিয়ে রাখবে, চাহিবামাত্রই তাকে নির্যাতনের মওকা মেলাবে। ভিডিও ভাইরাল হয়েছে বলে চার নির্যাতক গ্রেপ্তার হয়েছে। সিলেটের ঘটনায় নির্যাতনের শিকার নারীর পক্ষে শুরুতে একজন থানায় ফোন করায় পুলিশ নড়তে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ক্যামেরার চোখের বাইরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, আরও বড় বড় লোকের দ্বারা যেসব অনাচার ঘটে, সেসবের কী হবে? দেখছি না বলে সেগুলো ঘটছে না?
এই সমস্যার সমাধান কী আদৌ সম্ভব, কীভাবে সম্ভব? এক লেখায় এর উত্তর দিয়েছিলেন লেখক ও নৃবিজ্ঞানী হেলাল মহিউদ্দীন। তিনি লিখেছেন: এক. ধর্ষকদের গায়ের রাজনীতির পোশাকটি সরিয়ে ফেলুন বা পরতে দেবেন না। তাতেই ধর্ষণের সংখ্যা ৯০ ভাগ কমে যাবে। দুই. ইম্পিউনিটি, ‘আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকব, ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে আমার সংযোগ আছে’ এ রকম ভাবার সুযোগ বন্ধ করে দিন। আরও ৫টি ধর্ষণ বন্ধ হবে। তিন. ক্ষমতার রাজনীতিতে স্থান করে নেয়া নারীরা রাজনীতির সুবিধাভোগী হয়ে এই দুই শ্রেণির দুষ্কর্মে নীরব থাকবে না, তা নিশ্চিত করুন, আরও ৪টি ধর্ষণ বন্ধ হবে। চার. বাকি যে এক ভাগ ধর্ষক, ধরা যাক, হ্যাবিচুয়াল রেপিস্ট বা স্বভাবগত যৌন অপরাধী, তারা দুষ্কর্মের সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়বে। এমনকি আক্রান্ত নারীরাই তাদের কাবু করে ফেলতে পারবে। সেটা তখনই সম্ভব হবে, যদি তাদের আস্থা জন্মায় যে দেশের মানুষ রাজনীতিকে ব্যবহারকারী গুণ্ডাদের আর ভয় পাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে ধর্ষণের মহামারি থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানোর। আমরা একদা এসিড সন্ত্রাস দেখেছি। তখন এসিড নিক্ষেপকারীর বিরুদ্ধে সরকার কঠিন আইন জারি করলে সেটা বন্ধ হয়। বন্ধ হয় এসিডের অবৈধ বেচাকেনাও। এই হিসেবে আমরা বলতে চাই সরকারকে শুধু আইন প্রয়োগ করলে হবে না। পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও ও এর কারণ উৎস বন্ধ করতে হবে। নচেৎ এর কোনো হবে বলে আমরা মনে করি না।
এছাড়া এটি যেহেতু সামাজিক ব্যাধি সেহেতু সামাজিকভাবেই এর নির্মূল করতে হবে। পরিবার থেকে প্রথমে শিক্ষা নিতে নিতে হবে। তারপর তার পরিপার্শ্ব। এরপর সরকারি আইন যথাযথ প্রয়োগ হলে আমরা তখন অনেকটা ধর্ষণমুক্ত সমাজ দেখতে পাবো। নচেৎ এর বাইরে সবই অকার্যকর।