চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ধর্ষণকাণ্ড কি বন্ধ হবে না?

পত্রিকার পাতা খুললেই এখন চোখে পড়ে ধর্ষণের খবর। এই সব খবর পড়ে আতঙ্কিত হয়ে যাই। ভয় করে। হৃদয় কম্পিত হয়। আজকে রুপা, কালকে অমুখ, পরের দিন আরেকজন। এভাবে ধর্ষণের ঘটনায় পাতার পর পাতা ভরে যাচ্ছে। এই ধর্ষণ করে ধর্ষকরা পৈশাচিক আনন্দ পায়। সাময়িক জৈবিক উত্তেজনায় সুখ পায়। ধর্ষণের তালিকা দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে। কেন মানুষ এত অমানবিক হয়ে যাচ্ছে?

আজকে আমাদের শিক্ষা, সামাজিক দ্বায়িত্ববোধ কতটা অবদমিত হয়েছে তা কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে।রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস এমনকি নৌ-যানেও নারীরা ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে এসব আমরা জানতে পারছি। সর্বশেষ চলন্ত বাসে এলএলবি অধ্যয়নরত রুপা নামের একজনকে গণধর্ষণের পর ঘাড় মটকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা কতটুকু তা ভাবার বিষয়।

বিভিন্ন পরিবহনে ধর্ষণের ঘটনা বারবার ঘটছে। কোনো কোনো ঘটনায় ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। আর তার জ্বলন্ত প্রমাণ রুপা। এসব ঘটনায় আসামিরা ধরাও পড়ছে। তবে আমাদের দেখা উচিত ধর্ষণের কোন ঘটনায় কী বিচার হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে বিষয়গুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে।

২০১৫ সালের মে মাসে কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরার পথে রাজধানীতে গণধর্ষণের শিকার হন এক গারো তরুণী (২২)। কুড়িল বাসস্ট্যান্ড থেকে তাঁকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে একদল ধর্ষক। এই তরুণী যমুনা ফিউচার পার্কে একটি পোশাকের দোকানে কাজ করতেন। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে ধর্ষণের অভিযোগে তিনি ভাটারা থানায় মামলাও করেন। ঘটনার পর পার হয়েছে আড়াই বছর। দুই আসামি কারাগারে। বিচার চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ২০১৫ সালে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেওয়া যাচ্ছে না বিভিন্ন জটিলতায়। রাজধানীতে ঘটা এ ঘটনা তুমুল আলোচনায় এসেছিল।

বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। ধর্ষণের পর ওই তরুণী উত্তরা, খিলক্ষেত ও গুলশান থানা ঘুরে ১৬ ঘণ্টা পরে ভাটারা থানায় মামলা দায়ের করতে সক্ষম হন। পুলিশ এই ধরনের মামলা নিতে চায় না। ধর্ষিত নারীরা আর কত অবহেলিত হবেন?  লাঞ্ছিত হবেন বিচার চাইতে এসেও? গত বছর ৫ জানুয়ারি গভীর রাতে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের নান্দাইল চৌরাস্তায় একটি যাত্রীবাহী বাসের ভেতর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের শিকার নারী বাদী হয়ে নান্দাইল মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মামলা সেখানেই আটকে রয়েছে।

গত বছর বরিশালের নথুল্লাবাদে সেবা পরিবহনের একটি বাসে কুয়াকাটা থেকে আসা দুই বোনকে ধর্ষণ করেন গাড়িচালক ও তাঁর সহকারীরা। এ ঘটনায় বরিশাল মহানগর পুলিশের বিমানবন্দর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনার বিচার এখন শেষ হয়নি। ২০১৩ সালে মানিকগঞ্জেচলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন এক পোশাকশ্রমিক। ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় চালক দিপু মিয়া ও তাঁর সহকারী কাশেম আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল মামলায় এক আসামি কারাগারে থাকলেও আসামি দিপু মিয়া এক বছর ধরে জামিনে আছেন।

গত ২ আগস্টনারায়ণগঞ্জ মহানগরের সিদ্ধিরগঞ্জে চলন্ত ট্রাকে ১৫ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেন ট্রাকের চালক ও হেলপার। এলাকাবাসীর সহায়তায় পুলিশ ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে। কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে নারীদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। বাসের সব যাত্রী নেমে গেলে বিপদ আঁচ করতে হবে। তখন ওই বাস থেকে নেমে যেতে হবে অথবা উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে। মামলার প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতায় বিচার তো কোনোটারই সম্পন্ন হচ্ছে না। ক্ষমতায় থাকা মন্ত্রী, সাংসদেরা বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা কথাও বলছেন না। প্রধানমন্ত্রী যদি ধর্ষণের বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন এবং নিজে নজরদারি করেন তাহলে হয়তো কিছুটা ফলাফল পাওয়া যাবে।

পরিবহন মালিকেরা যানবাহনকে নিরাপদ করে তোলা বা কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের আচরণগত দিকটি বিবেচনায় রাখার ব্যাপারে কোনো আলাদা পদক্ষেপ নেননি। যেটি তাদের করা উচিত। বাসের হেল্পার, সুপারভাইজার ওদের নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই নিয়ে নেয়া হয়। আসলে ওদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। পরিবার থেকেও তারা কোন শিক্ষা পায়নি। তাই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন তাদের মৌলিক শিক্ষার জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ, ন্যাক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পাচ্ছেন না। একটি স্বাধীন, সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এর চেয়ে বড় লজ্জার, দুঃখের ও আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে?

যে কোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এ ধরনের ঘটনা সমগ্র সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও পাপাচারের দিকে ধাবিত করে-যা কখনই ভালো কোনো বিষয় হতে পারে না। সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরী। ধর্ষকরা অনেক সময় শাস্তি পায় না বলে পরবর্তীকালে স্পর্ধা পেয়ে যায় এবং বীরদর্পে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এটা দেখে অন্যরাও একই কাণ্ড করতে উৎসাহিত হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ সবার একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্ষণকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করা।

এ ক্ষেত্রে সবাইকে মনে রাখতে হবে, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণ যেমন একটি বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধ, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও তা বড় ধরনের পাপ। আবার সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ধর্ষণকে অত্যন্ত ঘৃণ্য, নিন্দনীয় ও খারাপ প্রকৃতির কাজ হিসেবে দেখা হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যে সমাজে নারীরা বেশি মাত্রায় ধর্ষণের শিকার হন, সেই সমাজের নারীরা দেশ-জাতির উন্নয়নে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন না। অথচ নারীদের পশ্চাতে রেখে একটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতিসহ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এবং একটি সুখী, সুন্দর দেশ ও জাতি গঠনে ধর্ষণকে কঠোর হস্তে দমন করা অপরিহার্য।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)