পবিত্র রমজানকে স্বাগত জানিয়ে ‘অধিক মুনাফার লোভে পণ্য মজুদ না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করার আহবান’ জানিয়ে মিছিল করেছে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ। শুক্রবার (১ এপ্রিল) জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদের সামনে থেমে মিছিলটি শুরু হয়ে শহরের কয়েকটি মোড় ঘুরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছে। সমাবেশে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ ব্যবসায়ীদের অনুরোধ জানিয়েছেন অধিক মুনাফার লোভে পণ্য মজুদ না করে কৃত্রিম সংকট তৈরি না করতে। পাশাপাশি তারা সিন্ডিকেট, মজুতদার ও পণ্যের সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ছাত্রলীগের ওই মিছিল ও সমাবেশে নগর পর্যায়ের শীর্ষনেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটির যেমন রয়েছে গৌরবময় অতীত, তেমনি রয়েছে বিতর্কিত সাম্প্রতিক অতীতসহ বর্তমান। স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিল এই সংগঠনটি। ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী। ছাত্রলীগের অতীত পর্যালোচনায় রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে এমন মিছিলের খবর ব্যাপক আলোচনার সন্দেহ নেই। এটাকে বিবর্তনের প্রক্রিয়াও ধারণাও অনেকের। তারা রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে কোন কর্মসূচি পালন করবে, এবং সেখানে স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষনেতারা উপস্থিত থাকবেন, এমনটা আগে ভাবেনি কেউ। এই মিছিল আমাদেরকে অবাক করলেও চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহাম্মেদ ইমু জানিয়েছেন, প্রতিবারই তারা মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করে থাকেন, এটা তারই ধারাবাহিকতা। তার এই বক্তব্য প্রমাণ করছে ছাত্রলীগের এই ধরনের কর্মসূচি সম্পর্কে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় সংসদও অবহিত। ফলে এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবার অবকাশ নাই।
তবে ধারণা করা যাচ্ছে, এবারই ব্যাপক সংখ্যক লোক ছাত্রলীগের এই ধরনের কর্মসূচির কথা জেনেছে। জেনে অবাক হওয়ার কারণ রমজানকে স্বাগত জানিয়ে যেসব কর্মসূচি দেশে আগে হয়েছে এবং বর্তমানে হয় তার সবটাই করে থাকে ধর্মের নামে পরিচালিত সংগঠনগুলো। এই তালিকায় যেমন আছে জামায়াতে ইসলামি, আছে ইসলামি ছাত্রশিবির, ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, তালামিযে ইসলামিয়াসহ নানা সংগঠন। এমন ভূমিকায় আগে কোথাও দেখা যায়নি ছাত্রলীগকে। এখন এমন মিছিল সমাবেশ করে ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে ধর্মের নামে পরিচালিত ওইসব সংগঠনের কাতারে নাম লিখাল।
ভুল বাক্যে, ভুল বানানে লিখা একটা ব্যানার বহন করেছে ছাত্রলীগ। এতে তাদের আদর্শিক পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষাদীক্ষার দীনতা প্রকাশ পেয়েছে। মাত্র কয়েকটি শব্দের একটা ব্যানারে এমন ভুল তাদের শিক্ষার মান সম্পর্কেও আমাদের ধারণা দিচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই আমরা হতাশ।
মিছিলের মাধ্যমে ‘অধিক মুনাফার লোভে পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করার আহবান’ জানিয়েছে সংগঠনটি। জানতে ইচ্ছে করে এই কি উদ্দেশ্য তাদের? এটাই যদি প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়ে থাকত তবে সাম্প্রতিক সময়ের অসহ বাজার পরিস্থিতি নিয়ে তারা আগে থেকেই কথা বলত। বলেনি। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল মানুষ। তারা মানুষের কথা বলার চাইতে সংগঠনের নীতি-আদর্শের বাইরে গিয়ে স্রেফ ধর্মীয় রূপে নিজেদের প্রকাশ করতে চেয়েছে, যা এতদিন করে আসছে ছাত্রশিবিরসহ অপরাপর ধর্মাশ্রিত সংগঠনগুলো।
ছাত্রলীগের কাঁধে কেন হুট করে এই ধর্ম ঢুকল? তারা তো কোন ধর্মভিত্তিক সংগঠন নয়, ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনও সংগঠনের নীতি-আদর্শের নয়। তবে তারা ছাত্রশিবিরের, তালামিযের, ছাত্র আন্দোলনের প্রক্সি দিল? কেন দিল?
আমরা যখন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরোধিতা করছি, আমরা যখন বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাইছি তখন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের এই মিছিল ও সমাবেশ উদ্বিগ্ন করছে, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ছাত্রলীগ যেহেতু, সেখানে ছাত্র থাকাটাই স্বাভাবিক, এবং এরাই একটা সময়ে গণসংগঠনের নেতৃত্ব দেবে, জনপ্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করবে; কিন্তু তাদের এই পরিবর্তন দেশকে আরও বেশি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দেবে। এরা ভবিষ্যতে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
আওয়ামী লীগের সকল পর্যায়ের অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে অনেকের অভিযোগ। এটা যে মিথ্যা নয় তা বারবার প্রমাণিত। ছাত্রলীগের মধ্যে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল রয়েছে-এটা সংগঠনটির নানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলে আসছেন। আদর্শিক স্খলনের কথাও বলছেন অনেকেই। কিন্তু এত এত আলোচনা সত্ত্বেও নীতিনির্ধারকেরা এ নিয়ে কিছু বলছেন না। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আশকারা দিচ্ছেন। তাদের আশকারায় কি স্খলনের মাত্রা বাড়ছে না?
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের বড় একটা অংশ মুখে এর বিরোধিতা করলেও নেত্রীকে নিয়ে সে একইধরনের ধর্মীয় প্রচারণাও চালাচ্ছে। নেত্রী তাহাজ্জুদ পড়েন, কোরআন তেলাওয়াত করেন, অপর দলের নেত্রী মদ খান, নামাজ পড়েন না-ধর্মকেন্দ্রিক এমন নানা প্রচারণা। এই প্রচারণাগুলো আমাদেরকে রাজনৈতিক শুদ্ধির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে দিনে-দিনে লোকজন প্রকৃত অর্থে ধর্মের দিকে না ঝুঁকে ধর্মকে স্রেফ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানাচ্ছে। এই মিছিল হয়তো এখন পর্যন্ত সবশেষ উদাহরণ, তবে এর আগে আরও অনেক আছে এমন। মামুনুল হকসহ হেফাজত ইসলামের নেতারা যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন তখন দেশের বিভিন্ন এলাকার ছাত্রলীগের স্থানীয় কিছু নেতা প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে সংগঠন ত্যাগ করেছে। আদর্শিক রাজনৈতিক চর্চা থাকলে এগুলো ঘটত না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ করেছেন, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন; শেখ হাসিনা নিজেও ছাত্রলীগ করেছেন, কৌশলের রাজনীতির আবর্তে বর্তমান হলেও তার ছাত্রলীগের জমানায় তিনিও ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল প্রতিনিধি। অথচ তাদের সেই ছাত্রলীগের আজ এ অবস্থা!
ছাত্রলীগকে কেন তালামীয-ছাত্রশিবিরের অনুরূপ কর্মসূচি দিতে হবে? রাজনীতিতে কেন ধর্মকে ব্যবহার করবে? প্রশ্ন। উত্তর কে দেবে? জানি দেবে না। তবু প্রশ্নটা করছি। উত্তর না আসলেও অন্তত তারা জানুক প্রশ্ন করার মতো কেউ কেউ এখনও অবশিষ্ট আছে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)