আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দু’টি আলোচিত পত্রিকা লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান এবং ওয়াশিংটনের দ্য ওয়াশিংটন টাইমস বাংলাদেশের মৌলবাদি রাজনীতি নিয়ে দু’টি সংবাদ-বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। ওয়াশিংটন টাইমসের নিবন্ধটি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। আর দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণটি তৈরি করেছেন দু’জন সাংবাদিক এবং তারা এটি তৈরি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতকারের ভিত্তিতেই।
দু’টো নিবন্ধের সুরই মোটামুটি এক, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জঙ্গিবাদ এবং তার সঙ্গে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি। আমি প্রকাশিত নিবন্ধ দু’টি নিয়ে আলোচনা করতে চাই না কারণ আগ্রহী পাঠক চাইলেই অনলাইনে লেখা দু’টি পড়ে নিতে পারবেন এবং একই সঙ্গে এর অনুবাদও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এরইমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
সজীব ওয়াদের জয়ের নিবন্ধের মূল প্রসঙ্গ বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং তার প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক জামায়াত ইসলামীকে নিয়ে। তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি একটি বড় বাধাই কেবল নয়, বরং গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর (পড়ুন ব্লগার) যে হামলার ঘটনা ঘটছে তাও এই জামায়াতে ইসলামীরই মদদে ঘটেছে।
দ্বিতীয়তঃ তিনি বিষয়টি জড়িয়েছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে, যেহেতু জামায়াতে ইসলামীর মূল নেতৃত্বই এই বিচার প্রক্রিয়ার সম্মুখীন সেহেতু তিনি মনে করছেন যে, এই বিচারের কারণেই ব্লগারদের ওপর হামলা হয়েছে। কারণ হামলার শিকারদের প্রায় সকলেই যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দিয়েছেন এবং তাদের মূল সমালোচনা আসলে জামায়াত ইসলামের রাজনীতির বিরুদ্ধে।
জয় যে মিথ্যে বলেননি সেকথা আমরা সকলেই জানি। কারণ, গণজাগরণ মঞ্চ যে সময় যাত্রা শুরু করেছিল তখন আমরা নতুন করে যে বিপদটি টের পেয়েছিলাম তাহলো, বাংলাদেশকে আসলে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা হচ্ছে। আস্তিক এবং নাস্তিক। যদিও এই বিভক্তি ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যারা তাদেরকেই নাস্তিক আখ্যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধবাদীদের আস্তিক প্রমাণের সেই প্রাণান্ত চেষ্টার দিনগুলি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
গণমাধ্যম এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল, নিরপেক্ষতার নামে তখন দেদারসে মিথ্যাচার প্রচারেরও সুযোগ করে দিয়েছিল সে সময়। গণজাগরণ মঞ্চ যখন জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তুলেছিল তখন আমরা সরকারের নীরবতায় কষ্ট পেয়েছি বটে কিন্তু বিষয়টি যে আদৌ নীরবতা ছিল না, ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা তা সজীব ওয়াজেদ জয়ের এই লেখা থেকে স্পষ্ট হয়।
এই নিবন্ধ ছাড়াও তিনি তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে একথা জোর দিয়েই বলেছেন যে, জামায়াত ইসলামীর রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে, আইন সংশোধন করে হলেও এটা করা জরুরি। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের কাছে আইন করে কোনো গোষ্ঠীর রাজনীতি বন্ধের বিষয়টি কষ্টদায়ক লাগতে পারে কিন্তু গণতন্ত্রকে “গণতান্ত্রিক” করার জন্য হলেও মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রয়োজন রয়েছে।
সুখের কথা হলো, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই প্রশ্নটি উত্থাপন করে জয় আমাদের ব্যাপক আলোচনার পথটি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, এখন পক্ষে-বিপক্ষে এবং এর প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলতে পারে, যদিও এটা শুরু হওয়ার প্রয়োজন ছিল আরো অনেক আগেই। দেরিতে হলেও এটা হচ্ছে এবং সরকার ও দলীয় রাজনীতির উচ্চ পর্যায় থেকেই সেটা হয়েছে বলে খানিকটা স্বস্তি প্রকাশ করতেই হচ্ছে।
অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকারভিত্তিক যে সংবাদ-বিশ্লেষণটি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার গুরুত্ব অন্যখানে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পরে বাংলা ভাষাভাষীদের সবচেয়ে বড় অংশটি এখন বসবাস করে লন্ডনে, যে কারণে লন্ডনকে তৃতীয় বাংলা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ব্রিটেনের নিজের ঘরে যেমন মুসলিম অভিবাসীদের নিয়ে নতুন করে নাটকীয় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে তেমনই বাংলাদেশেও বিগত সময়ে কয়েকটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্রিটেনে বসবাসরত তরুণ প্রজন্মের বাঙালিদের ভেতর যে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার আছর বাংলাদেশে এসেও আছড়ে পড়ছে।
এমনিতেও সেই ১৯৭১ সাল থেকেই বাংলাদেশ-বিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল লন্ডন, এখনও এই লন্ডনে বসেই বাংলাদেশের মূল ধর্মভিত্তিক রাজনীতিটি পরিচালিত হচ্ছে। ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নীল নক্সার অংশীদার লন্ডন, ফলে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির সেই ধারাবাহিক ও ঐতিহাসিক চর্চাটি এখনও লন্ডনকেন্দ্রিক। যে কারণে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন ব্রিটেনেই মূলতঃ আওয়াজ তোলা হয় যে, বাংলাদেশে ইসলাম বিপন্ন এবং হিন্দুত্ববাদী ভারত বাংলাদেশকে দখল করে নিচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই তরুণ ও ধর্মপ্রাণ বাঙালির ভেতর জোরেসোরে আওয়ামী লীগ-বিরোধী প্রচারণা শুরু হয় এবং তারা এতে ব্যাপকভাবে প্রভাবিতও হয়।
এর মূল কারণ কী তা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যেতে পারে কিন্তু আবারও সেই গণজাগরণ মঞ্চ’র শুরুর দিকের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি যখন পূর্ব লন্ডনের রাস্তায় বাংলাদেশের নাস্তিকদের কতল করার আহ্বান সমৃদ্ধ পোস্টারও লাগানো হয়েছিল, বাকি তৎপরতার কথা না হয় নাই বা বললাম। দ্য গার্ডিয়ানের এই বিশ্লেষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সহযোগিতা চেয়েছেন এদেশে উগ্রবাদ দমনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ব্রিটেন থেকে আগত বাঙালি তরুণদের দ্বারা সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে।
ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন ক্যামেরন সরকার বিগত মেয়াদে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে দেশটিতে উজিয়ে ওঠা উগ্রবাদ নিয়ে। কঠোর আইন প্রণয়ন করেও এটা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে সমাজ বিশ্লেষকরা গবেষণায় প্রমাণ করেছেন কারণ যে কোনো কঠোর আইনই আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস বা মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। অপরদিকে সাধারণ নাগরিকের জীবন রক্ষার তাগিদে এই ধর্মীয় উগ্রবাদ ঠেকানোও জরুরি হয়ে পড়েছে। এরকম অবস্থায় নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আহ্বান ব্রিটিশ সরকারকে নতুন করে ভাবনায় ফেলবে। ব্রিটেন বিষয়টি কেমনভাবে গ্রহণ করে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
মজার বিষয় হলো, ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের কাছ থেকে মূল ভূখণ্ড বাংলাদেশের এই বিপদের আশঙ্কার কথাটি ঠিক সেই মুহূর্তে ব্রিটিশ মূল ধারার গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে যখন বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়া ব্রিটেন সফর করছেন। একথা সর্বজন বিদিত যে, জামায়াতে ইসলামী তথা বাংলাদেশে ধর্মাশ্রয়ী উগ্র রাজনীতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়া। নিঃসন্দেহে বিষয়টি তার এই সফরের ওপর এক ধরনের চাপ হিসেবে আলোচিত হবে সকল মহল থেকেই। জানি না, বিএনপি নেত্রী ব্রিটেনে কার সঙ্গে দেখা করবেন বা তার কর্মসূচি কি, তবে মূলধারার কোনো রাজনীতিবিদের সঙ্গে দেখা হলে তাকে অবশ্যই এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে। কথা হলো, তাতে কি বেগম জিয়ার রাজনীতিতে কোনো হেরফের ঘটবে?
লন্ডনে আশ্রয় গ্রহণকারী তার পুত্র তারেক জিয়া বেশিরভাগ সময়ই পরিবেষ্টিত থাকেন তার জামায়াতী সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা, তার সেই বিখ্যাত উক্তিও আমরা ভুলতে পারি না, তিনি বলেছিলেন, জামায়াত (শিবির) ও বিএনপি এক মায়ের পেটের দুই ভাই। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিই যদি এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে ও অন্যকথায় সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয় তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক চরিত্র কতোটা কঠোর হতে পারবে?
সে কথা তাহলে থাক, আমরা বাংলাদেশের ভেতরকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলি। একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আমরা যতোটা শান্ত মনে করি না কেন, আসলে পরিস্থিতি কি ততোটাই শান্ত? আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, না, পরিস্থিতি আসলে ভেতরে ভেতরে অনেকটাই উত্তপ্ত। বিশেষ করে, ক্ষমতার বাইরে থাকা উগ্র ডানপন্থী ও ধর্মাশ্রয়ী শক্তিটি মিলেমিশে যে বলয় তৈরি করেছে তা আসলে অগ্নিগিরির মতো ফুটন্ত। যে কোনো সময় লাভ উদগিরণ হবে, সন্দেহ নেই।
সাধারণতঃ আমরা মনে করে থাকি যে, সরকার এসব বিষয়ে মনোযোগী নয়। কিন্তু আমরা যে ভুল তা প্রমাণিত হয়েছে একই সময়ে সজীব ওয়াজেদ জয় ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতকার ভিত্তিক এই সংবাদ-বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে। আগেই বলেছি যে, বিষয়টি অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক। কারণ, দুর্ঘটনা হঠাৎ করে ঘটে না, তার পূর্বাপর জানা থাকলে আমাদের জন্য অত্যন্ত সহজ হয় সেটা সামাল দেয়া। এখন এই সচেতনতা দলের একেবারে মূল পর্যন্ত পৌছানো গেলে তা সাধারণ্যের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। সরকার একা যে এই মৌলবাদী দানব দমনে যথেষ্ট নয় সেকথা বলাই বাহুল্য। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই এদেরকে ঠেকাতে হবে, সেজন্য আইনী কাঠামো বদলানোর প্রয়োজন পড়লে তাও করতে হবে। তাই নয়?
কিন্তু আরেকটি বিষয় উল্লেখ করেই আজকের লেখার ইতি টানতে চাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ইসলামীর আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার প্রশ্নে প্রায়শঃই আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’কে গুলিয়ে ফেলি। বিশেষ করে, ছিয়ানব্বই সালে বিএনপি-বিরোধী আন্দোলনে জামায়াত ইসলামী আওয়ামী লীগকে সমর্থন করায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগকে প্রায় সত্যের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন অনেকেই। কিন্তু যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জামায়াতকে তোষণের এই অপপ্রচারে কান দেননি তারা আজকে একটু আনন্দ করতেই পারেন যে, আসলে যা প্রচার হয় তা হয়তো সঠিক নয়।
প্রধানমন্ত্রী পুত্রতো কেবল আর একজন ব্যক্তিমাত্র নন, তিনি আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত কাণ্ডারীই হয়তো, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব অর্থাৎ শেখ হাসিনা এবং ভবিষ্যত নেতা সজীব ওয়াজেদ জয় যখন জামায়াতি রাজনীতির বিরুদ্ধে একই সুরে কথা বলেন তখন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে একটুখানি আশাবাদী হওয়াই যায়, কী বলেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের
নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে
প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)