সময়টাকে ঠিক স্বাভাবিক বলা যাচ্ছে না। এটি কোন স্বাভাবিক দৃশ্য নয়, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি প্রকাশ্যে তার ভাষায় ‘তথাকথিত বিচারকদের’ সমালোচনায় মেতে ওঠেন। এটি স্বাভাবিক নয় যখন রাষ্ট্র নেতারা সংবিধান প্রদত্ত সুরক্ষা ভঙ্গ করে সংবাদকর্মীদের হুমকি প্রদান করেন এবং এটিকে কিছুতেই স্বাভাবিক বলা যাবে না, যখন দেখি এফবিআই প্রধান যে মানুষটির বিরুদ্ধে নির্বাচনকালীন রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে তদন্ত করছিলেন তার দ্বারাই বরখাস্ত হলেন।
না এই মুহূর্তে কিছুই স্বাভাবিক নেই, অন্তত আমেরিকানদের জন্য তো বটেই।
কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি ইতোপূর্বেও দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। এবং সে কারণেই বলছি এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যেও আমি আশার আলো খুঁজে পাই। আমি আর্মি-ম্যাককার্থির শুনানিতে ছিলাম। আমি মনে করতে পারি ইতিহাস। আমাদের দু’দলেরই কিছু সমর্থক অথবা সেই সমস্ত সাধারণ মানুষ যারা দলীয় রাজনীতির ধার ধারেন না- তারা এক সময় একযোগে দাঁড়িয়ে বলেছেন-যথেষ্ট হয়েছে আর নয়।
আমার মনে পড়ে যুদ্ধ ফেরত ১৯৭০-এর সেই দিনগুলোর কথা যখন আমি এমন এক দেশে ফিরে এসেছিলাম যে দেশ তার নিজের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। যেখানে মানুষকে তার বিবেকের বাণী উচ্চারণের জন্য আক্রান্ত হতে হতো । তারপর ছোট্ট সাদা-কালো টিভির পর্দায় দেখলাম ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি সংবাদ। কিন্তু ১৯৭৪-এ এক নতুন স্রোত নির্বাচিত হয়ে এলো কংগ্রেসে যে স্রোতে ভেসে গেল দুর্নীতি, দেশ ফিরে পেল তার সঠিক গতিপথ।
কাজেই এই সাময়িক দুঃসময়কে বিবেচনায় নিয়ে, প্রতিদিন আমরা যে যুদ্ধরত তাকে সামনে রেখেই বলছি আমি আশাবাদী। আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুঃসময়ে জেগে ওঠে এবং সবচেয়ে ভাল কাজ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪১ বছরের ইতিহাসও সেই সাক্ষ্য দেয়।
সামনে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। আমাদের মুক্ত বিশ্বের অন্যদের নিদ্রা থেকে জাগিয়ে একযোগে লড়াই করতে হবে প্রকৃত শত্রুদের বিরুদ্ধে, যা আমরা করছি না। সারা বিশ্ব আজ প্রযুক্তির বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যা শিল্প বিপ্লবের মতোই। কিন্তু সেই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সক্ষমতা অর্জনে আমরা ব্যর্থ। প্রযুক্তিকে বাণিজ্য হিসেবে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় আমাদের নাগরিকেরা এই শতাব্দীর প্রথম দশকে ৫.৬ মিলিয়ন চাকরির ৮৫% হারিয়েছে।
এটি যথেষ্ট হতাশার যে আমরা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ও ওহিওর বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এখনও কর্মসংস্থানের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা কি করে আগামী দিনগুলোর মোকাবেলা করব! বিশেষ করে যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা আর রোবটিক্সের প্রভাবে মানুষ যখন কাজ হারাচ্ছে। কর্মসংস্থান হয়ে আসছে সীমিত।
পরিবেশ বিপর্যয়ে আজ পৃথিবী নামক গ্রহটি যে বিপজ্জনক দিকে ধাবিত হচ্ছে এ বিষয়ে আমরা উটের মতো মাটিতে মুখ গুজে থাকতে পারি না। আর এই বিপর্যয় খুব দূরেও নয়। আমাদের ভুল করা চলবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে তবে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনিবার্য। আমি এখনও বিশ্বাস করি আমরা যদি সঠিক পথ বেছে নিতে পারি তাহলে হতাশার কোন কারণ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি গ্লোবাল লো-কার্বন ইকোনমির পথে হাঁটব যা আজ প্রয়োজন। অবশ্যই আমরা সে পথে যাব। সঙ্কটের জায়গাটা হলো আমরা সিদ্ধান্ত নিতে কতটা সময় নেব?
পরিবেশ বিপর্যয় রোধে আমাদের দ্রুততার সঙ্গে সাড়া দিতে হবে। সাম্প্রতিক সংবাদগুলো আমাদের নিজেদের শক্তি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দেয়। ম্যানচেস্টারে হামলা প্রতিটি বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষের ক্রোধকে জাগ্রত করে। কিন্তু আমরা এখনও জঙ্গীবাদের সংজ্ঞা নিরূপণে বিতর্কে লিপ্ত। তাকে মোকাবেলার কোন দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বাদ দিয়ে। আজ যদি আমরা কোন দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থ হই, তবে প্রতি চার বছর অন্তর একজন নতুন রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নতুন নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ভিন্ন মাত্রার আক্রমণের মোকাবেলা করতে হবে।
একবিংশ শতাব্দীর জন্য আজ চাই নতুন পরিকল্পনা। এই সত্য আমাদের মেনে নিতে হবে যে, কোন একক সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব নয়। এই পারস্পরিক সংযুক্ত বিশ্বে আমেরিকা একা পথ চলতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যদের সাথে নিয়েই পথ চলতে হবে।
আজ সারা বিশ্বে ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার অনুৎপাদনশীল অলস অবস্থায় আছে। সরকার, ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে এই অর্থ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্লিন এনার্জির, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগ করা যায়।
আমেরিকান ও সারা বিশ্বের জনতাকে আজ অবশ্যই সমৃদ্ধির পথ বেছে নিতে হবে। কিন্তু আমরা কখনই দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান পাব না যদি আমরা দীর্ঘ মেয়াদী সঙ্কট মোকাবেলায় সততার সঙ্গে অগ্রসর হই।
লেখক: জন কেরি ( সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী)