মাহমুদুল ইসলামের ঈদের নাটক ‘দ্য অরিজিনাল আর্টিস্ট’। পুরস্কার, নৈতিকতা, গ্রহণ বর্জনের টানাটানির গল্প এটি। নাটকটি একটি সুড়সুড়ি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে শুরু। নায়িকা বৃষ্টিতে ভিজবে, তার পূর্বের মেকআপ! এখানেই এই নাটকের মূল চরিত্র, দ্য অরিজিনাল আর্টিস্ট, মেকআপ আর্টিস্ট মোহাম্মদ আলির সাথে আমাদের দেখা।
চশমা পরা সংসারি ভদ্রলোক, চেহারায় পরিচয়। আদপেও তাই। পুরাতন এক বাড়িতে তার সস্ত্রীক বাস। খবরের কাগজে প্রকাশ, তিনি ‘আর্ট অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। যথারীতি আনন্দ! সেই আনন্দে বাঁধসাধে একটা ভুল। মোহাম্মদ আলি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বটে কিন্তু তা আর্ট ডিরেক্টর ক্যাটাগরিতে, অথচ তিনি একজন মেকআপ আর্টিস্ট। এখানেই যত গলদ। শিল্পীর শিল্পসত্তা বিট্রে করে।
একজন শিল্পী সব সময় সবচেয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম। শিল্পীর সার্বভৌমত্ব প্রকৃত শিল্পী কখনও খর্ব হতে দেন না। শিল্প করা লোকটি চলতি সিস্টেমের সাথে খাপ খাওয়াতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়ে থাকেন। এই গল্পেও বিনা শব্দে পুরস্কারটি নিয়ে নিলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়, কিন্তু শিল্পী তা করতে পারেন না। শিল্পীর এই সার্বভৌমত্ব তাকে কম্প্রোমাইজ করতে দেয় না। মোহাম্মদ আলি তাই দ্বারস্থ হন ‘উপর মহল’-এর। কিন্তু সেই ক্লাসিক্যাল গোয়ারতুমি , ‘বস সব সময় ঠিক’! ফলে বসের ভুল, ভুল না! আমাদের সিস্টেমের কাছে শিল্পী অদরকারি মানুষ, প্রায়। ফলে আমাদের বসকুল বলেন, ‘আপনাদের সমস্যা কি জানেন, আপনাদের সমস্যা হচ্ছে, অ্যাওয়ার্ড না পেলেও কমপ্লেইন নিয়ে হাজির হবেন, আর অ্যাওয়ার্ড পেলেও আপনারা কমপ্লেইন করবেন। আরে বাবা, অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তো নিয়ে যান, ক্যাটাগরি কোন ম্যাটার হলো নাকি!’ তখন শিল্পীকে বলতেই হয়, ‘না, এটা আমার এথিকসে পড়ে না!’
কিন্তু বড়লোকের, কর্তা কিংবা বসের ভুল তো ভুল না! তাই ব্যাপারটা দাঁড়ায়, ‘খাবি না কেন, খা!’ আর্টিস্টকে বাধ্য করা হবে। আমরা দেখি, কর্তারা আর সিনে থাকেন না। থাকেন পাণ্ডারা, রাজনৈতিক হানাহানিতে যেমন নেতাদের দেখা যায় না। তাই এখানে একটি অপ্রধান চরিত্রের টানাপোড়েন দেখা যায়। দস্তগির। তার দুই কূল রক্ষার দায়। আমরা মাঝে মধ্যে নিজেরাই নিজেরদের আবিস্কার করবো দস্তগিরের ভেতর। তিনিই মধ্যবিত্ত। নিজের চাকরি বাঁচানোর দায়। বসকে ঠাণ্ডা রাখার দায়। আর্টিস্টকে পুরস্কার গছানোয় দায়। সব তার। এই চরিত্রটির টানাপোড়েন ভিন্ন মাত্রার। ফলে অনেক সময় মূল গল্পের আড়ালে সে পড়ে গেলেও সেই যেন আমাদের ব্যক্তিত্বের সেতু। তার ঘরে তাহলে মা’ও থাকে! তার ক্যান্সারও হয়।
সে আবার দালাল দুই পক্ষের! রাজি করানো যার কাজ। তার সত্য ও মিথ্যা ফারাকহীন। ফলে সে পুলিশ নিয়ে যায় আবার পায়ে ধরে ফিরে! তাহলে? তাহলে আর্টিস্ট তার গোঁ ধরা এথিকসের বাইরেও যেতে পারেন। তা হল বৃহৎ মানবিক প্রয়োজন। ক্যানসার রোগী বাঁচবে না নইলে, চাকরি থাকবে না। যার জন্য, তার নাম নেই না আমরা। বরং আমরা পুরস্কার নিতে মনস্থির করি। শিল্পীর কাছে নির্বিষ সত্যের চেয়ে, নৈতিকতার চেয়ে মানবিক প্রয়োজন অনেক বেশি গভীর। ফলে তাকে কম্প্রোমাইজ করায় মানবিক প্রয়োজন। আপাত খারাপ। তবু আমাদের ব্যাস দেবের কথা মনে হয়, সত্যের ইচ্ছা হলে আমাকে রেখে চলে যাক, আমি সত্যের দাসত্ব করি না। বুদ্ধ আমাদের পাশে দাঁড়ান, “সৌভাগ্য আসে পরার্থপরতা হইতে/ দুর্ভাগ্য আসে স্বার্থপরতা হইতে।” এতে চাকরি বাঁচে দস্তগিরের, বাঁচে তার মা।
পুরস্কার, নৈতিকতা, শিল্পীর দায়, শিল্পীর নৈতিকতা, বড়কর্তাদের উদাসীনতা, সাধারণের ব্যক্তিক সমস্যা… সব নিলে খুব ছোট পরিসরে বড় একটা গল্প ‘দ্য অরিজিনাল আর্টিস্ট’। মেকআপ ম্যানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কবি কামরুজ্জামান কামু। কামু নিজেও পুরস্কার বিষয়ক জটিলতার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। পুরস্কার নেয়া না নেয়া বিষয়ে তার ব্যক্তিক অবস্থান আছে। “…পারতপক্ষে যার পটেনশিয়ালিটি বেশি তাকে পুরস্কার দেয়ার চেষ্টা করতে হবে, এইটা রক্ষা করলে সৎভাবে, এই প্রতিষ্ঠানটা (যেকোনো প্রতিষ্ঠান অর্থে নিতে পারি) ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে এবং আমি সেটা চাই।” প্রশংসাকেও একপ্রকার পুরস্কার ধরাই যায়। সেই অর্থে কামুর অভিনয় প্রসংশার দাবী করে। খুব সাধারণ চেহারা, চলন বলন বাজার করা ছাপোষা কিন্তু শিল্পী! সাবলীল। সাথে বাড়তি পাওনা যুক্ত হয় আর আকর্ষণীয় কণ্ঠ।
মুকিত মজুমদারের অভিনয়ে ফানি ভাব প্রকট ছিল, সিরিয়াস মোমেন্টেও। ফলে তার প্রকাশভঙ্গি বেশিরভাগ সময়ই চরিত্রের টানাপোড়েনের প্রতিনিধিত্ব করে নি। নাবিলার টেনে-টেনে কথা বলা বাদ দিলে বেশ ভালো। সুখি বউ।
মাহমুদুল ইসলামের ‘দ্য অরিজিনাল আর্টিস্ট’-এর নৈতিকতার বাড়বাড়ন্ত হয়তো আমাদের এই সময়ে একটা ইউটোপিয়ান ব্যাপার মনে হবে। তবু সততা আর নৈতিকতাতেই মানুষের বাস। শিল্পী তো সবচেয়ে সংবেনশীল মানুষ। সততা আর নৈতিকতাই মানুষকে সুখি করে, করে নির্মল- “খোদ আপনাকে যখন বাসনা হইতে মুক্ত করিব/ আমরা তখন নির্মলতা ও মুক্তিকে চিনিব।”
‘দ্য অরিজিনাল আর্টিস্ট’ নাটকটি দেখতে পারেন এখানে: