আরবিতে বহুবচনের শব্দ আখলাক। এর একবচন খুলুক অর্থাৎ চরিত্র। চরিত্র বলা হয় ঐ বৈশিষ্ট্যকে, যা কোনরূপ বাধ্যবাধকতা বা সংকোচন ছড়াই মানুষ নিজ থেকে প্রকাশ করে। মানে কারো নিজ থেকেই যখন কোনোকিছু অনায়াসে বেরিয়ে আসে, তাই চরিত্র।
যেমন কোনরকম অনায়াসে মিথ্যা বলা। কিন্তু বাধ্য হয়ে বললে তা তার চরিত্র বলে পরিগণিত হবে না। অনুরূপ সত্য বললেও তা যতক্ষণ পর্যন্ত বাধ্যতামুক্ত হবে না, ততক্ষণ ঐ বৈশিষ্ট্য তার চরিত্রে অন্তর্ভুক্ত হবে না। চরিত্র আবার দু’ধরণের। সচ্চরিত্র ও দুশ্চরিত্র। সচ্চরিত্র নন্দিত এবং দুশ্চরিত্র সবসময়ই নিন্দিত।
নবি কারিম (সা.)- এর আখলাক বা চরিত্র সমস্ত মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম রোল মডেল। তিনি যাবতীয় দোষ-ত্রুটি এবং চারিত্রিক কলুষ থেকে মুক্ত। মুক্ত করেই আল্লাহ পাক তাঁকে প্রেরণ করেছেন। নবিজি (সা.) পৃথিবীর পৃষ্টে এসে সেকথা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি যাবতীয় উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দিতে’ (কানযুল উম্মাল)।
সচ্চরিত্র শেখানোর এক মহান সিলেবাস নিয়ে আগত নবিকে চরিত্রের ভাল-মন্দ নির্ধারণের মানদন্ড দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (সূরা: কলম, আয়াত: ৪)। তাই কোন চরিত্রকে কে ভাল বলল, আর কে মন্দ বলল, তা একজন মুসলিমের দেখার বিষয় নয়; নবি কারিম (সা.)- এর পবিত্র ব্যক্তিত্বই আমাদের জন্য সচ্চরিত্র নির্ধারণের মাপকাঠি।
সর্বোপরি তিনি যা বলেছেন, করেছেন, এবং যাতে সায় দিয়েছেন, তাই আমাদের জন্য অনুসরণীয়, অনুকরণীয় আদর্শ। কেননা আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূল (সা.)- এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’ (সূরা: আহযাব, আয়াত: ২১)।
রাসূলে কারিম (সা.) অতুলনীয় মানব হয়ে এসেছেন। মানবজাতির কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছাতে হলে মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও মানবিক দৃষ্টিতে যা কিছু সচ্চরিত্র, তা ধারণ করার বিকল্প নেই। তাই নবুয়ত প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ চল্লিশটি বছর শুধু উত্তম চরিত্র, আচার-ব্যবহার দিয়ে তিনি পৃথিবীর মানুষকে কাছে টানেন। আকৃষ্ট করেন চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে। কখনো কখনো দেখা যেত, শত্রুরাও তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকত।
সবমিলিয়ে যা দিয়ে প্রিয়নবি (সা.) মানুষকে কাছে টেনেছেন এবং মানবিকতা বিকাশে যা অপরিহার্য তা নিয়েই এ বিষয়ের অবতারণা। নবি কারিম (সা.)- এর সচ্চরিত্রের স্বীকৃতি হিসেবে সহিহ বুখারিতে উল্লেখিত হিরাক্লিয়াসের সাথে আবু সুফিয়ানের ঐতিহাসিক বর্ণনাটি সবার আগে উঠে আসে। আবু সুফিয়ান তখনও ইমান আনয়ন করেন নি।
পারস্য সম্রাট যে প্রশ্নগুলি তাকে করেছিল, তার উত্তরগুলি ছিল অত্যন্ত চমৎকার। তা সাক্ষ্য দিয়েছিল শেষ নবির সত্যতার বিষয়ে। আবু সুফিয়ান তখনো মুসলমানদের শত্রু। তাকে বলতে বলা হয়েছিল মহানবির সততা নিয়ে। জিজ্ঞেস করা হয়, তোমরা কি ওনাকে মিথ্যাবাদী মনে করো? শত্রু হয়েও আবু সুফিয়ান একবাক্যে জবাব দেয়, ‘না’ । একজন শত্রুর কাছ থেকে কৃতিত্বের স্বীকৃতি নেয়াই তো বড় শ্রেষ্ঠত্ব।
মহানবি (সা.)- এর জীবনী অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি আজীবন সত্য বলেছেন। যিনি মানুষের কাছে, মানুষের ব্যাপারে কখনো মিথ্যা বলেন না, তাঁরপক্ষে মানুষের স্রষ্টা সম্পর্কে মিথ্যা বলা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তাই মানুষ দলেদলে ইসলাম গ্রহণ করেছে।
আজও ইসলামের প্রচার-প্রসার করতে চাইলে মুসলমানদেরকে মিথ্যা ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যেতে হবে। পাশাপাশি মানবিক উন্নয়নেও ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন পর্যন্ত মিথ্যার সংশোধন অপরিহার্য।
প্রিয়নবি (সা.)- এর চারিত্রিক সৌন্দর্যের অনন্য দিক হলো তিনি সবসময় নম্রতা অবলম্বন করতেন। কখনো শক্ত মেজাজে কথা বলতেন না। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহর অনুগ্রহের কারণে আপনি তাদের প্রতি নম্রতা হয়ে গিয়েছেন’ (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ১৬৯)।
মহানবি (সা.)- এর এই নম্রতা মানুষকে ইসলামের কাছে আরো টেনে এনেছে। এজন্য হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ঐ ব্যক্তির জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করা হয়েছে, যে কিনা নম্র হৃদয়বান, সচ্চরিত্রের অধিকারী এবং লোকদের সাথে মিলেমিশে চলে’ (মুসনাদে আহমদ ও ইবনে হিব্বান)।
অন্য এক হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি নরম মেজাজ থেকে বঞ্চিত হলো, সে যেন কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়ে গেলো’ (মুসলিম, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)। নম্রতা শুধুই আচার-ব্যবহারে নয়। কথা, কাজের সবখানে নম্রতা অবলম্বন করা সুন্নাত। বিশেষকরে, যারা ইসলামের প্রচার-প্রসারে বক্তৃতা করেন, ইসলামের সঠিক দিকগুলো তুলে ধরেন, তাদের উচিত নম্রভাষী হওয়া।
মুখের রুঢ় ভাষা শ্রোতার অপছন্দের কারণও হয়। এজন্য ইমাম গাজালি (রহ.) বলেছেন, ‘কথা বলার সময় নম্রতা অবলম্বন করবে। কেননা শব্দ থেকেও শব্দের ধ্বনি অধিকতর আকৃষ্ট করে থাকে’। বাস্তবতাও তাই। কিন্তু সমাজে ঘটছে এর বিপরীতটা; দিনদিন আমাদের মধ্য থেকে নম্রতা যেন উঠে যাচ্ছে।
আর চারিদিক ছেয়ে যাচ্ছে কঠোরতা, সংকীর্ণতা ও ঘৃণা জাল। ফলে শান্তির সমাজ অশান্তির অতল গহ্বরে আজ নিমজ্জিত। এর কারণ নবি কারিম (সা.)- এর পবিত্র আখলাক থেকে আমাদের সরে আসা।
সারা পৃথিবীতে বড় সমস্যার আরেকটি হচ্ছে পরধর্ম বা পরমতে অসহিষ্ণুতা। ভিনধর্ম বা ভিনমতের কথা শুনলেই আমাদের শরীর আঁতকে উঠে। ভিন্নমতের মানুষ দেখলেই আমরা দূরে সরিয়ে দেই। যা কিনা বর্তমান পৃথিবীতে দাওয়াতি কাজ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ।
কিন্তু মহানবি (সা.) এমনটি করতেন না। কেউ হাজারো বেয়াদবি করলেও তিনি তার সাথে সদাচারণ করতেন। তাড়িয়ে দিতেন না; ইসলাম সম্পর্কে মধুর ভাষায় তাকে বোঝাতেন। সাহাবাদেরকেও পরধর্মে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিতেন। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত ঐ ইহুদি ঘটনা তো আমরা অনেকেই জানি, যার কাছ থেকে নবিজি কিছু ঋণ নিয়েছিলেন।
ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময় পেরুনোর ২/৩ দিন আগেই নবিজির কাছে এসে সে প্রাপ্য অর্থ দাবি করল। এমনকি নবি কারিম (সা.)- এর শানে মারাত্মক পর্যায়ের বেয়াদবিও প্রদর্শন করল। তাতে হযরত ওমর (রা.) রাগান্বিত হয়ে তাকে ধমক দিলেন।
কিন্তু নবিজি ছিলেন একেবারেই নীরব। আর একটু পরই মুচকি হেসে ওমরকে বললেন, ‘ওমর, আমি ও ঐ ব্যক্তি তোমার পক্ষ থেকে অন্য আচরণের আশাবাদী ছিলাম। তোমার উচিত ছিল, সত্বর তার প্রাপ্য আদায়ের ব্যাপারে আমাকে পরামর্শ দেয়া এবং তাকে নম্রতা অবলম্বনের তাগিদ দেয়া’।
এরপর নবিজি ওমরকে কঠোরতার বদলাস্বরূপ নির্ধারিত প্রাপ্য থেকে অতিরিক্ত বাড়িয়ে ঐ ইহুদির ঋণ পরিশোধের নির্দেশ দেন। প্রিয়নবি (সা.)- এর এ নম্রতা ও সহিষ্ণুতা দেখে ইহুদি যায়েদ ইবনে সানা তাৎক্ষণিক ইসলাম গ্রহণ করে।
এটি ঊষার আলোর ন্যায় প্রতিভাত যে, ইসলাম তলোয়ারে প্রসারিত হয় নি। যতটুকু পৌঁছেছে তা কেবল এর সৌন্দর্য ও মাধুর্য দিয়ে। নবি কারিম (সা.)- এর চারিত্রিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বহুলোক ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করেছে। দীর্ঘসময়ের জুলুম-অত্যাচার ভুলে গিয়ে মক্কাবিজয়ের দিন তিনি যে ক্ষমার নীতি গ্রহণ করেছেন, তা ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
শুধু মক্কাবিজয়ের ঘটনাই নয়, নবিজির ৬৩ বছরের প্রতিটি আচরণই ছিল বিশ্বের জন্য অবাক করা। পৃথিবীর বহু সীরাতগ্রন্থকার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছেন, করছেন এবং করতে থাকবেন। তবুও সেই মহান ব্যক্তিত্বের আখলাক, আচার-ব্যবহার, বৈশিষ্ট্য কখনো শেষ হবার নয়।
পরিশেষে বলা যায়, প্রিয়নবি (সা.)- এর আখলাখের অনুকরণই মুসলিম বিশ্বকে দাসত্বের পিঞ্জিরা থেকে মুক্ত করতে এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে পারে।