নিজস্ব স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের আকাশ এবং মহাকাশের সম্ভাবনাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সদর দপ্তর এর রিক্রুটমেন্ট অধিদপ্তর এর পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ।
তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন রাজু আলীম।
প্রশ্ন: স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নতুন যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশের। আপনার মূল্যায়ন কী?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: বাংলাদেশের ইতিহাস এনালাইসিস করলে দেখা যায়- সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে আমাদের যে অ্যাসপিরেশন ছিলো তা কিন্তু ভিন্ন মাত্রার। পৃথিবীর আর কোন দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমান বাহিনী গঠনের কথা চিন্তা করেনি। আমরা করেছি এবং আমরা কিন্তু সফলভাবে করেছি এবং পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একমাত্র বাহিনী যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের মধ্যে গঠিত হয়েছে এবং বিজয় লাভ করেছে।এই ধারাবাহিকতায় আপনি যদি দেখেন- যদিও বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছি উঠে এসেছি এবং তারই একটা পদক্ষেপ হিসেবে আজকের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ আমাদের নিজস্ব।এটি একটি বিষয়ই প্রতিফলন করে যে, জাতী বা দেশ হিসেবে আমরা কতদূর এগিয়ে এসেছি। দেশ পজিটিভ দিকে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তারই প্রতিফলন।
প্রশ্ন: মাত্র তিনটি বিমান নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী যাত্রা শুরু করেছিল- সেই অবস্থা থেকে এখন কোন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে আমাদের বিমান বাহিনী?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: আমরা শুরু করেছি মাত্র তিনটি বিমান দিয়ে কিন্তু একটি বিমান বাহিনী গঠনের জন্যে যা প্রয়োজন তার জন্যে দেশের সামাজিক অবস্থা একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দেয়। দেখতে হয় আমাদের দেশ প্রথমে তার কোন জায়গায় তার গুরুত্ব দিচ্ছে। আমি কি আমাদের জনগণের উন্নতি চাচ্ছি নাকি দেশের সামরিক শক্তির উন্নতি চাচ্ছি? তার সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে কিন্তু ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হয়।দিনে দিনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি হচ্ছে এবং সেই সাথে আমাদের সামরিক শক্তিরও উন্নতি হচ্ছে।তাই বিভিন্ন সময় ফাইটার ক্রাফট ক্রয় করা এবং বাহিনীকে যুগোপযোগী করা হয় তা আমাদের সামর্থ্যের ভেতরে থেকে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সাল থেকে মিগ টুয়েন্টি ওয়ান তখনকার দিনের সর্বাধুনিক বিমান আমরা নিয়ে এসেছি।তারপরে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মিগ টুয়েন্টি নাইন এনেছি। আর এখন ফোরথ জেনারেশনের ফ্লাই বাই ওয়্যার সম্বলিত ইয়ারড ওয়ান থার্টি এয়ার ক্রাফট নিয়ে এসেছি এবং অতি সম্প্রতি আমরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছি সি ওয়ান থার্টি জে এয়ার ক্রাফট নিয়ে আসার জন্যে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এখন এটাই ব্যবহার হচ্ছে। আমরাও এটি নিয়ে আসতে পেরেছি তা গর্বের ব্যাপার। আমাদের সক্ষমতাকে অনেকাংশে বৃদ্ধি করবে এটি।
প্রশ্ন: বিমান বাহিনীতে নিয়োগ পাওয়া অনেক সম্মানের? আপনাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু জানতে চাই?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: যে কোন প্রফেশনেই নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাই শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ হওয়া উচিৎ। যেহেতু আমাদের প্রচুর মূল্যবান জিনিসপত্র হ্যান্ডেল করতে হয়, অপারেট করতে হয় এই কারণে যোগ্যতার বিষয়ে আমরা কোন জায়গায় কোন প্রকার ছাড় দিতে পারি না? যে যোগ্যতা আমারা নিরূপণ করি সেই যোগ্যতা আমরা যাতে বজায় রাখতে পারি সেটা আমাদের রিক্রুটমেন্টের প্রথম দায়িত্ব যে, আমরা যাদেরকে নিচ্ছি তারা আমাদের প্রশিক্ষণের জন্যে যোগ্য কিনা? আমি তাই বলবো এই রিক্রুটমেন্টে ভর্তি হওয়ার জন্যে ভাগ্যের চেয়ে নিজেকে যোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করা বেশি জরুরী। আর কেউ যদি যোগ্য হন তবে তিনি তো গৌরব বোধ করবেনই?
প্রশ্ন: আপনাদের রিক্রুটমেন্টে নারীদের অবস্থা কেমন?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: ২০০০ সাল থেকে প্রথমে আমরা মেয়েদের কর্মকর্তা হিসেবে রিক্রুট করা শুরু করি এবং গত ৫/৬ বছর আগে আমরা বৈমানিক হিসেবেও রিক্রুট করা শুরু করেছি। এখন প্রশ্ন হলো- আমরা কি যোগ্যতার বিষয়ে ছাড় দিচ্ছি কিনা? না- আমরা এখানেও ছাড় দিচ্ছি না? আমাদের এখানে যে সব মেয়েরা আসে তারা নিজেদের যোগ্যতা বলেই এসেছে।
প্রশ্ন: সিনসিয়ারিটির জায়গায় কোন গ্যাপ নেই?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: কোন জায়গায় কোন ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এটা অবশ্যই আমাদের বিমান বাহিনীর জন্যে এবং সর্বোপরি দেশের জন্যে গর্বের বিষয় যে, আমাদের মেয়েরাও এই যোগ্যতার উপযোগী এবং তারা এই যোগ্যতা সব সময়ই প্রুফ করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: বিমান বাহিনীতে এখন নারী সদস্যের সংখ্যা কতো?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এখন কর্মকর্তা হিসেবে প্রায় দুই শত জন আছেন।
প্রশ্ন: আপনাদের সাফল্য এবং এখনকার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি। কারণ এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠান।১৯৯৫ সাল থেকে আমরা জাতিসংঘ মিশনে ফ্লাইং করে আসছি। এটি কিন্তু খুব কম দেশই করে। কঙ্গো কিংবা হাইতির মত দেশ যা পৃথিবীরে অপর প্রান্তে সেখানেও আমাদের বিমান চলাচল করছে। এটি অবশ্যই সবার গৌরবের ব্যাপার এবং সেখানে দুইজন নারী পাইলট রয়েছে। যা অবশ্যই সম্মানের সবার জন্যে দেশের জন্যে।
প্রশ্ন: বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত এই দৃপ্ত শপথে বলিয়ান বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আসামের ডিমাপুরে ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে গঠিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পথচলা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: ১৯৭১ সনের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্ম। নিজ দেশের মুক্তি সংগ্রামের পটভূমিতে গঠিত হয়ে সরাসরি কমব্যাট অপারেশনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ীর বেশে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার মত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস হলো বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইতিহাস। এমন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পৃথিবীর কোন বিমান বাহিনীর নাই। বিমান বাহিনীর প্রতিটি সদস্য এজন্য অত্যন্ত গর্বিত। আমাদের সেই সব বীর পূর্বসূরিদের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ আমাদেরকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে সময়ের পরিক্রমায় বিমান বাহিনী আজ প্রায় সব ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আজ বাংলার আকাশ মুক্ত রাখার মিশন বাস্তবায়নে বিমান বাহিনী অনেক বেশী সক্ষম ও আত্মপ্রত্যয়ী। গতবছর বর্তমান সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে বিমান বাহিনীর এ ঐতিহাসিক অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা আমাদের মনোবলকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সংখ্যা নয় গুণগত উৎকর্ষতা, সুপরিকল্পিত বিকাশ এবং কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সদাপ্রস্তুত থাকতে আমরা সদাপ্রচেষ্ট।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একাধিক বাঙ্গালী বৈমানিক, অন্যান্য কর্মকর্তা ও বিমানসেনা পাকিস্তানী পক্ষ ত্যাগ করে বা পালিয়ে এসে বিভিন্ন সেক্টরে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আবার অনেকেই সরাসরি মূল বাহিনীর সাথে থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: জ্বি, আপনি ঠিক বলেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনীর সদস্যদের অবদান সত্যিই গর্ব করার মত। তৎকালীন পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের বাঙালী সদস্যদের মধ্য থেকে একটি বড় অংশ ২৫ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যে যেভাবে পেরেছেন বেরিয়ে গেছেন। আরেকটি অংশ পাকিস্তান বা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নানাভাবে পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছেন। বিমান বাহিনীর সদস্যরা প্রায় সবাই প্রথমত সেনা বাহিনীও মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্থলযুদ্ধ করেছেন। এমনকি বিমান বাহিনীর বেশ ক’জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার এভিএম এ কে খন্দকার থেকে শুরু করে উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান,(এভিএম খাদেমুল বাশার, এভিএম সুলতান মাহমুদ, স্কো: লী: বদরুল আলম, স্কো:লী: লিয়াকত আলী খান, ফ্লা:লে: শামসুল আলম) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অপরদিকে তৎকালীন পিআইএ’এর বাঙালী পাইলটদের আরেকটি অংশও এসে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এসব সামরিক- বেসামরিক পাইলট ও টেকনিশিয়ানদের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক কিলো ফ্লাইট গড়ে উঠেছিল। সর্বোপরি শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের কথা তো আমরা সবাই জানি।
এভাবে সব মিলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য একজন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬ জন বীর উত্তম, ১ জন বীর বিক্রম, ১৫ জন বীর প্রতীকে ভূষিত হয়েছেন।
প্রশ্ন: মাত্র তিনটি বিমান নিয়ে এই বাহিনীর যাত্রা শুরু হয় যার মধ্যে ছিলো একটি ডাকোটা বিমান, একটি অটার বিমান এবং একটি অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার। আজ এই পর্যায়ে এসে বিমান বাহিনীর বহর কতোটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: দেখুন, এ বিষয়টি আমি একটু ব্যাখ্যা করতে চাই। একটি বিমান বাহিনীর স্বয়ংসম্পূর্ণতা নির্ভর করে কিছু বিশেষ বিবেচনার উপর। যেমন জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সম্ভাব্য শত্রু মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় জনবল, যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র, প্রশিক্ষণ, দুর্যোগ মোকাবেলা ও জাতিসংঘ মিশনসহ আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে দায়িত্ব পালন ইত্যাদি নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটি রাষ্ট্র তার সামরিক বাহিনী তথা বিমান বাহিনী গড়ে তোলে। তার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত বিষয় হলো জাতীয় অর্থনৈতিক সামর্থ্য, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রাধিকারপ্রাপ্ত সেক্টর সমূহ, সামরিক শিল্প ও গবেষণার অবকাঠামো তথা যুদ্ধবিমান বা যন্ত্রাংশ ও সমরাস্ত্র উৎপাদন বা ক্রয়ক্ষমতা ইত্যাদি। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও ডিপ্লোম্যাটিক সম্পর্কও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিগত ৪৭ বছরে আমরা ধাপে ধাপে আমাদের বিমান বাহিনীকে প্রয়োজন মত যথেষ্টে শক্তিশালী রূপে গড়ে তুলছি। যেহেতু আমরা এখনও যুদ্ধবিমান, মিসাইল ইত্যাদি বড় ধরনের সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করার মত শিল্প স্থাপন করতে পারিনি, তাই এসব জিনিস আমাদেরকে আমদানী করতে হয়।
এ সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশ সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষ করে আকাশ সীমার নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে আমরা এমন একটি সুপ্রশিক্ষিত, সুযোগ্য ও কার্যকর বিমান বাহিনী গঠন ও সদাপ্রস্তুত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি, যা আকারে নয় যোগ্যতায় এমন কার্যকর ডিটারেন্স প্রদর্শনে সক্ষম হবে যে, যে কোন শত্রুপক্ষ বাংলাদেশকে আক্রমণের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লাভের চাইতে নিজের অবশ্যম্ভাবী বা অনিবার্য ক্ষতিকে অনেক বেশী মনে করবে।
প্রশ্ন: ১৯৭১ এ পরাজিত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফেলে যাওয়া পাঁচটি “স্যাবর এফ-৮৬” ছিলো এই বাহিনীর প্রথম জঙ্গি বিমান। বিমান বাহিনীতে এখন কতোগুলো জঙ্গিবিমান আছে?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ বিমান বাহিনী দীঘ ৪৭ বছরের যাত্রায় সংযোজিত হয়েছে বহুবিধ যুদ্ধ সরঞ্জাম। যে কোন দেশের বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান সংখ্যা মুখ্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে তার সামরিক সক্ষমতা।
সেই সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যা নয় গুণগত মানই হচ্ছে মূল বিবেচ্য বিষয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে রয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের অত্যাধুনিক মিগ-২৯ এয়ার সুপিরিয়ারিটি জেট ফাইটার এবং ৪র্থ+ প্রজন্মের এডভান্স জেট ট্রেইনার/লাইট এটাক ইয়াক-১৩০ বিমান যা কমপ্লেক্স ফ্লাই-বাই-ওয়ার কন্ট্রোল সিস্টেম সমৃদ্ধ। এছাড়াও অতি সম্প্রতি সর্বাধুনিক সি-১৩০জে পরিবহন বিমান ক্রয়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একটি অংশ। সামরিক বাহিনীর অংশ হিসেবে কোন কোন কাজে আপনারা অংশ নিয়ে থাকেন?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের রণাঙ্গনে যে বিমান বাহিনীর জন্ম হয়েছিলো, কালের পরিক্রমায় তা আজ একটি পরিপূর্ণ ও সুসজ্জিত বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। প্রথম থেকেই জাতির প্রত্যাশাকে সর্বোচ্চ মানদণ্ডে রেখে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আকাশ প্রতিরক্ষা ও আকাশ নিয়ন্ত্রণের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তামূলক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অপারেশনাল কর্মকাণ্ড হচ্ছে- ক. দেশের সার্বভৌমত্ব ও আকাশসীমা রক্ষা। খ. ঘাঁটি সমূহের অপারেশনাল কর্মকাণ্ড। গ. যুদ্ধবিমান সমূহের আক্রমণাত্মক সক্ষমতা অর্জন। ঘ. জাতীয় প্রতিরক্ষায় অপারেশনাল কর্মকাণ্ড।
ঙ. বিমান বাহিনীর অপারেশনাল মহড়া। চ. সেনা ও নৌ অপারেশনে সহায়তা প্রদান। ছ. জাতীয় কর্মকাণ্ডে অপারেশনাল কার্যক্রম জ. বৈমানিক ও ফাইটার কন্ট্রোলার এর প্রশিক্ষণ। ঝ. সার্বক্ষণিক আকাশসীমা নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ। এছাড়াও জাতীয় প্রয়োজনে আকাশ পথে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ এবং চিকিৎসা সেবা সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সকল সময়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
যে কোন দুর্যোগময় মুহূর্ত মোকাবেলা করতে বিমান বাহিনী তার দৈনন্দিন কার্যক্রমের সাথে বছরের ৩৬৫ দিনই বিমান বাহিনীর মূল ঘাঁটি সমূহে ০৩টি হেলিকপ্টার ২৪ ঘণ্টা উদ্ধার ও অনুসন্ধান (Search and Rescue) এর জন্য প্রস্তুত রাখে। আকাশ প্রতিরক্ষার সাথে সাথে বিমান বাহিনীর এই হেলিকপ্টারগুলো দেশের যে কোন স্থানের দুর্যোগ, মেডিকেল ইভাকুয়েশন, ক্যাজুয়ালটি ইভাকুয়েশন, উদ্ধার এবং অনুসন্ধান কার্যে সদাপ্রস্তুত থাকে।
প্রশ্ন: বর্তমানে এই বাহিনীতে ১৭,০০০ সদস্য কর্মরত আছেন। বিমান বাহিনীর জনবল কিভাবে আপনারা আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তোলেন?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: আমরা ১৯৮০র দশক থেকেই সব ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদানে সক্ষম। আমাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সেই ৮০র দশক থেকেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। বিভিন্ন বিদেশী বিমান বাহিনীর সদস্যসহ প্রতিনিয়ত সেনা ও নৌ বাহিনীর সদস্যদেরকেও নিয়মিত নানা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
তবে বিমান বাহিনী যেহেতু একটি অত্যাধুনিক কর্মপ্রযুক্তি নির্ভর বাহিনী এবং প্রযুক্তি সদা পরিবর্তনশীল, সেহেতু বিমান বাহিনীর সদস্যদের ক্রমাগত যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। বিশেষ করে নতুন কোন বিমান বা সমরাস্ত্র কেনা হলে সেটির উপর সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ১৯৯৩ সালে বসনিয়া হার্জেগোভিনায় শান্তিরক্ষী প্রেরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কার্যক্রম শুরু করে। এখন অবধি এইসব মিশনে বিমান বাহিনীর অবদান সম্পর্কে জানতে চাই?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এই পর্যন্ত ২৫টি শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত সফলতার সাথে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বাংলাদেশের সুনাম আন্তজা©তিক অঙ্গনে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করেছে। অদ্যাবধি, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৬ হাজার ৪৩০ জন সদস্য কুয়েত, পূর্ব তিমুর, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মালি প্রজাতন্ত্র, চাঁদ, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, সুদান এবং হাইতিসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতময় দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সফলভাবে সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।
বিমান বাহিনীর দুইজন মহিলা বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্ন-ই-লুতফী বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদান করেছেন এবং সফলতার সাথে অর্পিত কর্তব্য পালন করছেন।
কঙ্গোতে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ১টি সি-১৩০ পরিবহন বিমান, ৬টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার বিভিন্ন গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্টসহ মোতায়েন রয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে সামরিক বা বেসামরিক শাখায় নিয়োগ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কঠোর নিয়ম এবং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দেন আপনারা- এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাই?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেবার আবেদনপত্র এখন অনলাইনেই করা যায়। আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে উপযুক্ত হলে প্রার্থীকে জানানো হয়। এরপর নির্দিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রে লিখিত, মৌখিক এবং মেডিক্যাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণদেরকে নিয়মানুযায়ী যোগদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যারা যোগদান করতে চান তাদেরকে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে- আপনার সাজেশন কি?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন হায়দার আব্দুল্লাহ: বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একটি প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনী। সুতরাং এই বাহিনীতে যোগদানের জন্য পর্যাপ্ত একাডেমিক জ্ঞান অপরিহার্য। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শারীরিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখাও জরুরী। সর্বোপরি দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার মত দৃঢ় মনোবল ও দেশপ্রেম থাকতে হবে।