উত্তরপাড়ার জব্বার মেম্বার একটি স্কুল স্থাপন করেছেন সামনের নির্বাচনে নিজের পাড়ার সবগুলো ভোট পাওয়ার জন্য। স্কুল স্থাপন করেই ছাত্র সংগ্রহের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সাথে পরামর্শ করে ছাত্র সংগ্রহ করেন জব্বার সাহেব। এখন শিক্ষক হিসেবে কাদের নিয়োগ দিবেন সেই চিন্তায় বিভোর থাকেন জব্বার সাহেব।
পরামর্শ করেন স্ত্রী এবং বাড়ির মুরুব্বীদের সাথে। স্ত্রী পরামর্শ দেন: ওনার বড় ভাই পড়াশোনা করে বসে আছে দীর্ঘদিন, চাকুরি হচ্ছে না, তাই শিক্ষক হিসেবে তাঁকেই নিতে হবে। জব্বার সাহেবের ভাতিজাও কিছু করতে পারতেছে না তদুপরি সরকারি চাকুরির বয়স নেই। ভাতিজাকে না নিলে কেমন দেখায়! প্রধান শিক্ষক হিসেবে নেওয়া হয়েছে জব্বার সাহেবের ছেলেবেলার খেলার সাথীকে। স্কুল পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হলেন জব্বার সাহেব নিজেই। সুতরাং স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ক্যাটাগরি ও সভাপতি নিয়োগের চিত্রটা আমরা অনুভব করতে পারছি।
এই নমুনার মতো অনেক স্কুলই কিন্তু এমপিওকরণের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। এখন পাঠকের কাছে প্রশ্ন, এই স্কুলটাকে কি এমপিওকরণ করা উচিত?
এদিকে জব্বার সাহেবের এহেন কৃতকর্ম দেখে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী গফুর মেম্বারও পূর্ব পাড়ায় একটি স্কুল স্থাপনের কাজ শুরু করেন। তিনিও কোন ধরনের নিয়মের তোয়াক্কা না করেই শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে স্কুল চালিয়ে নিচ্ছেন এবং এসএসসি পরীক্ষায় ঐ স্কুল থেকে নিয়মিত ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করছে। এই হলো নন-এমপিও স্কুলের মোটামুটি সচিত্র।
আমি এখানে কাউকে ছোট কিংবা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য লিখতে বসিনি। লেখনিতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না হলেও কিছু বিশ্লেষণের মাধ্যমে সামগ্রিকতাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি তাতে সবগুলো বেসরকারি স্কুল সরকারিকরণ হলেও তেমন অসুবিধার কথা নয়। কিন্তু আমার মনে বোধোদয় হচ্ছে, দাবি পূরণ করতে গিয়ে যেন ভাল-মন্দ একত্র না করে ফেলি। নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে যেন এমপিওকরণ করা হয়, ঢালাওভাবে হলে সেটা কোনভাবেই ইতিবাচক হবে না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য।
মনে করুণ আপনি একজন অভিভাবক, আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ভবিষ্যতে আপনার সন্তানকে আপনি কি হিসেবে দেখতে চান? ভুলেও আপনি বলবেন না, নন-এমপিও স্কুলের শিক্ষক হিসেবে ছেলেকে দেখতে চান। তাহলে কি দাঁড়ালো আপনি অবশ্যই ছেলেকে কোন না কোন সরকারি চাকুরিতে দেখতে চান। সরকারি আর বেসরকারি শিক্ষকতার পেশায় যারা আসেন তাদের মধ্যে স্বাভাবিক পার্থক্য হিসেবে আমরা সাধারণত মেধাকে প্রাধান্য দেই । মেধার ভিত্তিতে যোগ্যরাই সরকারি স্কুলে চাকুরি পেয়ে থাকেন। আর যাদের মেধা একটু কম বা যোগ্যতার দিক দিয়ে ঘাটতি আছে তারা বেসরকারি স্কুলে চাকুরি গ্রহণ করে। এখন বেসরকারি স্কুলকে ঢালাওভাবে এমপিওকরণের মাধ্যমে যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন ব্যাহত হবে। ভবিষ্যতে চাকুরি প্রার্থীদের মধ্যে মেধার প্রতিযোগিতা কমে আসবে যা দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি হবে। তাই, আমি গণহারে এমপিওকরণের বিপক্ষে আমার মতামত তুলে ধরছি।
বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে কমপক্ষে ১টি করে নন-এমপিও হাইস্কুল রয়েছে। পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন এসব স্কুলে কি পদ্ধতিতে, কোন মানের শিক্ষা প্রদান করা হয়। কি অবাক করা বিষয়, কোন কোন স্কুলে প্রাইভেট পড়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়। আবার বর্তমানে দেখা যাচ্ছে গৃহ শিক্ষকের চাহিদা দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা পড়াশোনা কি অতই জটিল বিষয়, সারাদিন স্কুলে ক্লাস করার পরেও বাসায় ফিরে আবার গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে হবে। প্রত্যেক সামর্থবান অভিভাবকই বাসায় গৃহ শিক্ষক রেখে দিচ্ছেন সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই। তার মানে কি? কেন গৃহশিক্ষক রাখতে হচ্ছে বাসায়? সহজ উত্তর হলো, স্কুলে সঠিকভাবে পাঠদান হচ্ছে না। তারই প্রেক্ষিতে পড়াশোনায় ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে অভিভাবকদের বাধ্য হয়েই গৃহশিক্ষক রাখতে হচ্ছে।
এই যে, ব্যাঙের ছাতার মত কোচিং সেন্টার হচ্ছে সে ব্যাপারে আমাদের মনোবাসনা কি? কোচিং সেন্টারগুলো তো আর বন্ধ হচ্ছে না, বরঞ্চ চাহিদার প্রেক্ষিতে বেড়েই চলছে। কেন বাড়ছে কোচিং সেন্টার? মুখস্থ উত্তরের মতো বলা যায়, স্কুলে পাঠদান সঠিকভাবে হচ্ছে না। তাই ব্যক্তিক স্বার্থে কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়ার দিকে ঝুঁকছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর যাদের টাকা পয়সা বেশি তারা হয়তো বাসায় শিক্ষক রেখে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে। তার মানে কি দাঁড়ালো, স্কুলের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে অভিভাবকেরা। শহরের চিত্রই এমন দেখা যায়। গ্রামের চিত্র আরো করুণ হয়ে পড়ছে। মানহীন স্কুলগুলোকে এমপিওকরণ করা হলে ছাত্রদের ব্যাপারে শিক্ষকরা মনোযোগী না হয়েও আরো উদাসীন হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, আমি একটি গ্রামের চিত্র তুলে ধরছি আপনাদের সামনে। একটি হাইস্কুল রয়েছে, স্কুলের শিক্ষক ১০ এর অধিক। প্রধান শিক্ষক হরহামেশাই স্কুল কামাই (মিস) দিয়ে থাকেন। প্রধান শিক্ষক স্কুল কামাই দিলে অন্য শিক্ষকদের উপস্থিতির বিষয়টা সহজেই বুঝা যায়। স্কুলে ঠিকভাবে পড়ানো হয় না। অথচ বিএসসি শিক্ষক ঠিকই রোজ সকালে ব্যাচ করে প্রাইভেট পড়াতে আসেন। ইংরেজি শিক্ষকরাও ঠিক এমন কাজটাই করে থাকেন। লেখার শুরুতেই বলে নিয়েছি সচরাচর কেমন ছেলে-মেয়েরা নন-এমপিও স্কুলে শিক্ষকতা করতে আসেন। তদুপরি, যদি ক্লাসে ঠিকভাবে লেকচার না দেয় তাহলে আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের কি অবস্থা হবে একবার ভাবা যায়। তারপর বাধ্য হয়ে ছেলেমেয়েরা কোচিং সেন্টারের আশ্রয় নেয়, কোচিং সেন্টারে যারা পড়ায় তাদের নিয়েও ইতিহাস রচনা করা যায়। বিষয়টা এমন কেউই নিজের ইচ্ছেয় কোচিং পেশাতে আসে না, আশার ভেলায় স্বপ্নকে ভাসাতে ব্যর্থ হয়ে কোচিং পেশাতে আসে। খুব কম সংখ্যক নিজের ইচ্ছেয় কোচিং পেশাতে বা টিউশনি পেশাতে আসে। ক্লাশের ১ম, ২য় ও ৩য় কেউ কি কোচিং পেশায় আসছে, কিংবা নন-এমপিও স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় আসছে?
স্বাভাবিকভাবে কেউ আসছে না। কাজেই বিচার বিশ্লেষণ করে বেসরকারি স্কুলগুলোকে এমপিওকরণের আওতায় আনা উচিত।
কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে এমপিওকরণ করা যেতে পারে? পেশাদারি কোন প্রতিষ্ঠানকে এতদসংগে নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। স্কুলে সঠিকভাবে ক্লাশ, পরীক্ষার বিষয়ে তদারকি করা যেতে পারে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম অবশ্যই অনুসরণ করতে পারে। পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফলের ক্রমোন্নতি দেখে এমপিওকরণ করতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তা না হলে সফলতা ব্যর্থতার তুলনা করা সম্ভব হয় না। এমপিওকরণের ক্ষেত্রে স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এবং ক্লাশে উপস্থিতির হার ও শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদিকে নিয়ামক হিসেবে বেছে নিয়ে কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে এমপিওকরণ করা প্রয়োজন। সকলেই চাই আমাদের শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নতি এবং তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন অবশ্যই তা করা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)