পঞ্চকবির এক কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বাংলা সাহিত্য, নাটক, গান, ছড়া কিংবা কবিতা সব দিকেই রয়েছে তার অবাধ বিচরণ। প্রায় ৫শতাধিক গান রচনা করেছেন তিনি। তার গান, কবিতা গুলো বাঙালীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে স্থায়ীভাবে। কবির রচিত গানগুলো দ্বিজেন্দ্রগীতী নামেই পরিচিত। সংক্ষেপে ডিএল রায় নামেও পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। তাঁর বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হত। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। পিতার কাছ থেকেই গানের দীক্ষা হয় দ্বিজেন্দ্রের। পিতা ও পুত্র দ্বিজেন্দ্রলালকে নিয়ে প্রচলিত একটি ঘটনা সাহিত্য মহলে উল্লেখযোগ্য;
দ্বিজেন্দ্রলালের বয়স যখন পাঁচ বছর। পিতা কার্তিক চন্দ্র রায় ছিলেন একজন সুগায়ক। একদিন তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে খেয়াল গান গাইছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল একমনে শুনছে। গাইতে গাইতে পিতা কি একটা কাজে হঠাত্ উঠে গেলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল সেই অবসরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলো এবং চাবি টিপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে কার্তিক চন্দ্র ফিরে এসে শিশু পুত্রের কাণ্ড দেখে অবাক। ছেলে তার গাওয়া কঠিন গানটি ঠিক ভাবে শুরু করে গাইছে।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে আরেক অদ্ভুত ঘটনার জন্মদেন তিনি । একদিন ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্র পড়া তৈরি করে আসেনি। তাই শিক্ষক তাদের বললেন- “তোমরা সব ঘরের ধারে দাঁড়িয়ে পড়া মুখস্ত কর”। ছাত্ররা তাই করতে লাগল।
খানিক পরে তিনি দ্বিজেন্দ্রলালের দিকে তাকিয়ে বললেন-“তুমি কি করছো? ও, তোমার বই নেই? তাহলে কি করে পড়বে?”
দ্বিজেন্দ্র বলল-“আমার পড়া মুখস্থ হয়ে গেছে”।
শিক্ষক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- “কিভাবে?”
দ্বিজেন্দ্র জবাব দিল-“ওদের পড়া শুনে শুনে”
শিক্ষক পরীক্ষা করে দেখলেন সত্যিই তার পড়া শুনেই মুখস্থ হয়ে গেছে, অথচ সেই সব ছাত্রদের কেউ বই দেখে পড়া মুখস্ত করতে পারেনি।
গতানুগতিক রীতিনীতি ও প্রথাবিরোধী শ্লেষ আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপে ভরা অজস্র হাসির গান তার সঙ্গীতের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছে। তার গানে রয়েছে আধ্যাত্বিক আকর্ষণও। তার দেশপ্রেম ও তেজদীপ্ততা বার বার বিট্রিশ প্রভুদের বিরক্তির কারণ হয়েছে।
বিলেত থেকে উচ্চরত ডিগ্রি নিয়ে আসা ম্যাজিস্ট্রেট ডিএল রায়ের চাকরি জীবন ছিলো অনিশ্চিয়তায় আক্রান্ত। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে।
জীবনের স্বল্প পরিসরে তিনি রচনা করেন ২২-২৪ টি নাটক। তার প্রতিটি নাটকই ছিলো দেশপ্রেমে উজ্জল দীপশিখা। তাঁর নাটকগুলি চার শ্রেণিতে বিন্যস্ত : প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক ও সামাজিক নাটক।
মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে পড়া ব্যাঙ্গ কবিতা, নন্দলাল আজও বাঙালির উপমা হয়ে রয়েছে। তার রচিত গান, ‘‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা”, “বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ” ইত্যাদি আজও সমানভাবে দেশপ্রেমের শিহরিত জাগায়। কবির রচিত গানগুলোকে পাঁচ শ্রেণীতে বিভাজিত করেছেন দিজেন্দ্রগবেষকরা সেগুলো হলো দেশপ্রেম, প্রেম,পূজা, প্রকৃতি ও বিবিধ। তবে পরিতাপের বিষয় তার ৫শতাধিক গানের মাত্র একশর অধিক গান বর্তমানে রুয়াপনযোগ্য। বাকীগুলোর স্বরলিপী অপ্রাপ্ত রয়েছে। তার গানে যেমন স্বদেশ প্রেমের বিচরণ রয়েছে তেমনি রয়েছে নর-নারী জীবনের সুখ, দুখ আনন্দ বেনদার সংমিশ্রণ। উচ্চশিক্ষা নিতে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind । তিন বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে সংস্কারাছন্ন হিন্দু সমাজের নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয় তাকে ।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি। আর্যগাথা, ১ম খণ্ড (১৮৮৪),আর্যগাথা, ২য় খণ্ড (১৮৮৪), আষাঢ়ে (১৮৯৯),হাসির গান (১৯০০), মন্দ্র (১৯০২), আলেখ্য (১৯০৭), ত্রিবেণী (১৯১২) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শেষ জীবনে দ্বিজেন্দ্রলাল ছেড়ে দেন মাছ বা মাংস খাওয়া। হয়ে যান সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী। মাত্র ৫০ বছর আয়ু পেয়েছিলেন এই গুণীজন। প্রায়ই বলতেন তিনি আমরা বাঙালীরা নাকি জাতি হিসেবে জেগে ওঠতে পারি নি। ১৯১৩ সালের ১৭ মে পরলোক গমণ করেন এই কীর্তিমান বাঙালী।