প্রতিবছরের মতো এ বছরও দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। ‘বন্ধ হলে দুর্নীতি, উন্নয়নে আসবে গতি’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ। ১ এপ্রিল পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠান ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দুদক এ সপ্তাহ পালন করে। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ কমিশনের প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে কমিশনার ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ, এএফএম আমিনুল ইসলামসহ কমিশনের সকল স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ সপ্তাহের উদ্বোধন করেন। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৃণমূল পর্যায়ে দেশের প্রতিটি জলা, উপজেলা, নগর ও মহানগরে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করা হয়। কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে এ উপলক্ষে দুর্নীতিবিরোধী ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ও পোষ্টার প্রদর্শনী ২৬ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিল। দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সাভার জাতীয় স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন এবং শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। ২৭ মার্চ শিল্পকলা একাডেমিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে বিতর্ক, রচনা, পোষ্টার অংকন ও কার্টুন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ্ আবু সায়ীদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। দুদক সপ্তাহ উপলক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক এর চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এক বিশেষ সাক্ষাতকারে মিলিত হন। তিনি ১৯৫৫ সালে চাঁদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ আবদুল লতিফ। পেশায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার মায়ের নাম মাহফুজা বেগম। ইকবাল মাহমুদ ১৯৭২ সালে সাতক্ষীরার আশাশুনি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৪ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে অষ্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিসি ষ্টাডিজ বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। আর বর্তমানে তিনি জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ এর পিএইচডি এর ছাত্র। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ কর্মজীবনে ম্যাজিষ্ট্রেট, সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন পদে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিব হিসেবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক, ম্যানিলা এর নির্বাহী পরিচালক, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক এর নির্বাহী পরিচালকসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইকবাল মাহমুদ এর স্ত্রী খাদিজা বেগম পেশায় একজন চিকিৎসক। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। তাদের এক কন্যা ও পুত্র সন্তান রয়েছে। স্বনামধন্য এই সচিব ব্যক্তি সম্প্রতি দুদকের নানা কর্মকাণ্ড বিষয়ে কথা বলেন।
প্রশ্ন: প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের জন্যে দুদক কী কাজ করছে?
ইকবাল মাহমুদ: আপনার প্রশ্নে উত্তর দেয়া অত্যন্ত কঠিন। কঠিন এই জন্যে যে, খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে- আমি তা মনে করি না। কারণ পরিবর্তন করতে গেলে মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে সবার আগে। প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন প্রয়োজন। তারপরে সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সম্মিলন হলে পরিবর্তনের বিষয় আসে। বাইরে থেকে আপনারা মনে করেন অনেক পরিবর্তন হয়েছে- বাস্তবে এত পরিবর্তন হয় নাই। তবে একটা পরিবর্তন হয়েছে- সেটা হলো, আমরা যেভাবে একটা বার্তা দিতে চেয়েছি। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে- যে একটি জায়গা আছে যেখানে আপনি অন্যায় দুর্নীতি করে সবসময় পার পাওয়া যাবে না। এই যে বার্তা এটি দিতে আমরা সমর্থ হয়েছি। বড়লোক, গরীব, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যেই হোক না কেন- সমাজের যার যা অবস্থান থাকুক না কেন, দুর্নীতি করে পার পাওয়া যাবে- এই যে সংষ্কৃতি অর্থাৎ ‘রেফারেন্স ইজ প্রেফারেন্স’ এটা আমরা বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: ‘পাপে ছাড়ে না বাপে’ সমাজে বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে। আপনি বললেন, দুর্নীতি করে সব সময় পার পাওয়া যাবে না। কোনো সময়ই পার পাওয়া যাবে না দুর্নীতি করে- এই সংষ্কৃতি চালু করতে করণীয় কী আছে?
ইকবাল মাহমুদ: এটা কঠিন কাজ। সময় প্রয়োজন আরও। সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এটি করতে হবে। আপনি যে প্রসঙ্গ তুলেছেন এটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, ব্যবস্থা পরিবর্তন ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব না। আর এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যে ২১টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম আমরা তৈরি করেছি। অনেকে ভয় পায়, মনে করে এই টিম তদন্ত করতে এসেছে। আসলে আমরা তদন্ত করতে যাই নাই, অনুসন্ধান করতে গেছি- চলমান ব্যবস্থা এবং চলমান ব্যবস্থার কী দুর্বলতার কারণে দুর্নীতির পোকা আস্তে আস্তে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, সেই ব্যবস্থাকে দেখার জন্যে আমরা যাই- এই টিমগুলোর প্রধান কাজ এটি। এবং এই উৎসগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায়, সেই বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্যে এই টিমগুলো আমরা মাঠে নামিয়েছি।
প্রশ্ন: দুদক কী কী কাজ হাতে নিয়েছে। আর কী কী কাজ আপনারা সফলতার সাথে করেছেন? চার্জশিট, মামলা, কী পরিমাণ সাজা আর কী পরিমাণ গ্রেফতার করেছেন- সব কিছু মিলিয়েই জানতে চাই?
ইকবাল মাহমুদ: আপনার শেষ কথাটাই বলি, গ্রেফতার। আমরা দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো গ্রেফতার করতে চাই না। আমরা দেখি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আইনের কাছে আসছেন না, তার বক্তব্য আমাদের শোনা প্রয়োজন কিন্তু তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না- তখন তদন্তকারী কর্মকর্তা গ্রেফতারের পর্যায়ে যান। সে জন্যেই মূলত গ্রেফতার হন। আসলে গড়পড়তা গ্রেফতার আমরা করি না। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা গ্রেফতার করেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন হয়, তারা কোর্টে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে, কোর্ট তাদেরকে কারাগারে দেন কিংবা জামিন দেন। কারাগারে থাকার সময় আমাদের তদন্তকারী কর্মকর্তারা দরখাস্ত করেন, তার বক্তব্য নেয়া প্রয়োজন, তখন জেল গেটে আমরা বক্তব্য নেই। আমাদের মূল বিষয় হলো বক্তব্য নেয়া। বক্তব্য ছাড়া কোনো মানুষকে অভিযুক্ত করা, এফআইআর বা চার্জশিট দেয়া যায় না- এটি আইনসঙ্গতও না। সাংবিধানিকভাবেও বিষয়টা সঠিক না।
প্রশ্ন: আপনারা গ্রেফতার করলেন, আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে গেলো। বর্তমান সরকার স্বাধীনভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে- এই বিষয়ে জানতে চাচ্ছি?
ইকবাল মাহমুদ: প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। আমরাও বিশ্বাস করি এবং মনে করি। আসলে এটা বিশ্বাসের বিষয় যে, আমরা বিশ্বাস করি আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি। সে কারণেই আমরা স্বাধীন আসলে। আর আপনি আদালতের প্রসঙ্গে বললেন, এটি সম্পুর্ণ ভিন্ন বিষয়। আদালত তার বিচার বিশ্লেষণ বিবেচনায় তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেই রায় মেনে নিতে আমরা বাধ্য। আদালত জামিন দিলে বুঝতে হবে- তার জামিন সঠিক হয়েছে। আর জামিন না দিলেও সিদ্ধান্ত সঠিক বুঝতে হবে। আদালতের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা ঠিক না। আমার কথা, আদালতের রায়ই চূড়ান্ত এবং শিরোধার্য।
প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের ৫ বছরের যে কর্মপরিকল্পনা আপনারা দেখেছেন কিনা জানি না- সেই কর্ম পরিকল্পনার অগ্রাধিকার খাত হলো মাঠ পর্যায়ে সরাসরি জনগণ যে সেবা পান, সেই সেবা পেতে যাতে দুর্নীতির গন্ধ না থাকে, দুর্নীতি না হয়- এটাই মূলত আমাদের প্রধান কাজ। যে কারণে আপনারা দেখছেন, প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক টিমগুলো কাজ করছে। সে সবের বেশিরভাগই হলো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। মানুষ বিরক্ত হয় কখন? কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কাঙ্ক্ষিত সময়ে সেবা না পেলে জনগণ বিরক্ত হয়ে যান। দুর্নীতি হোক বা না হোক, সময় মতো সেবা না পেলেই মানুষ মনে করে, নিশ্চয়ই এখানে কিছু একটা লাগবে। স্পিড মানি লাগবে- সময় যখনই ক্ষেপণ হচ্ছে তখন বোঝা যাচ্ছে যে, তারা হয়তো কিছু চাইছেন? সময় মতো জনসেবার কাজ করে দেয়া- এর পদ্ধতিগত ব্যবস্থার কথা বলছি। সরকারকেও আমারা জানিয়েছি যে, আপনারা বিভিন্ন পর্যায়ে যে সেবা দিচ্ছেন এবং সরকারের যে অঙ্গীকার সেই প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী সেবাগুলো যাতে সময় মতো দেয়া সম্ভব মানুষকে। তাহলেই মানুষ কিন্তু এই দুর্নীতির বেড়াজালে আর আবদ্ধ থাকবে না। মানুষ কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চায়। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান যখন আমরা করি, তখন মানুষের অংশগ্রহণ দেখি। নবম দশম শ্রেণির আড়াই লক্ষ বাচ্চাকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি- তখন দেখলাম সাধারণ মানুষ সেই অহিংস মানব বন্ধনে অংশ নিয়েছে। তাদেরকে আমরা ডাকিনি কিন্তু তবুও তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এসে মানুষ মৌন প্রতিবাদ করেছে। এটি জনসচেতনতার একটি বড় বিষয়।
প্রশ্ন: দুর্নীতি দমনে ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে সবকিছু। এই বিষয়ে দুদকের অগ্রগতি কী?
ইকবাল মাহমুদ: এটি ভালো প্রশ্ন করেছেন। জনসেবা আর লেনদেনে মানুষের হাতের স্পর্শ থাকলে দুর্নীতির প্রসার হয়। এটা স্বাভাবিক প্রবনতা কিন্তু মেশিনের কাছে গেলে, আপনি যদি অন্ধকারের মধ্যে চলে যান- তাহলে দুর্নীতি আর থাকে না। কারণ মেশিন তো আর ভুল করে না। দুয়ে দুয়ে চার হয় সে তাই বলবে। কিন্তু মানুষ কখনো কখনো দুয়ে দুয়ে পাঁচ বলে ফেলবে-ভুল করে হলেও বলবে, তাই না? ডিজিটাল পদ্ধতির কারণে দুর্নীতি কমেছে। এই কারণে দুনীতির সূচকে ২ পয়েন্ট বেড়েছে- এটি আমার ধারণা। টিআইবি যে রিপোর্ট দিয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে- সে সম্পর্কে কেউ কোনো প্রশ্ন করেনা, আমি তো দেখছি না। টিআইবি দুর্নীতি সম্পর্কে যে ধারণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, প্রতিবছরই তারা করে এবং প্রত্যেকবারই অনেক হই চই হয়। সরকার বলে আমরা মানি না, সুশীল সমাজ বলে না এটা ঠিক হয়েছে। এবার কিন্তু কেউ কোনো কথা বলেনি। কারণ দুর্নীতির ধারণায় আমরা বেশ কিছু দূর এগিয়েছি। দুপয়েন্ট উন্নতি কিন্তু কম না।
প্রশ্ন: দুদকের কাজ চ্যালেঞ্জিং। সমাজের ক্ষমতাবান, বড় বড় রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, সরকারি আমলা- এদের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। কোনো চাপ এর সম্মুখিন হতে হয় কি?
ইকবাল মাহমুদ: চাপের কথা যখন বলছেন, চাপ কিন্তু আমি পাই না। গত এক বছরে কোনো চাপ অনুভব করিনি এবং ভবিষ্যতেও আশা করি আমি কোনো চাপ পাব না। কারণ আপনি যদি চাপ আহ্বান করেন, তবে চাপ আসে। আর যদি চাপ আহ্বান না করেন, তবে চাপ আসবে না। সরকার যখন কোনো কিছুর অনুরোধ করেন না কিংবা সরকার যখন তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটান না দুদকের মাধ্যমে। তখন আপনাকে বুঝতে হবে এটি বড় ধরণের সহযোগিতা। তাছাড়া সরকারের কাছে আমরা যে সব সহযোগিতা চেয়েছি- সবই আমরা পেয়েছি। এতেই মনে হয়, সরকার আন্তরিক এবং প্রধানমন্ত্রী তার সর্বশেষ ভাষণে ৩টি কথা বলেছেন, ‘আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে দুর্নীতি প্রতিরোধের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’ এটি কিন্তু সার্বজনীন, এটি যে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি তা নয়, আমার ধারণা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, সকল সরকারি কর্মকাণ্ডে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে দুনীতি কমাতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে ততোই দুনীতি কমবে।
প্রশ্ন: ওয়ান ষ্টপ সেবা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ কি আছে?
ইকবাল মাহমুদ: প্রশ্ন হলো, যখন আইনের সহায়তা প্রয়োজন হয়, উদাহরণ দেয়া যেতে পারে- কেউ আসছেন না আইনের কাছে, তখন হয়তো পুলিশের সাহায্য আপনার প্রয়োজন হয় বা অনেক আরও অনেক রকম সাহায্যের প্রয়োজন হয়। তখন আমরা রিকুইজিশন দেই। যতবারই রিকুইজিশন দিয়েছি ততোবারই কিন্তু র্যাব, পুলিশ বা অন্যরা সবাইকে পেয়েছি। আর্মির বিষয়টা অন্য। আমাদের আর্মি ডাকার প্রয়োজন হয় না। তবে ভবিষ্যতের কথা তো বলা যায় না। যদি ডাকতে হয়। তার পদ্ধতি ভিন্ন। তবে পুলিশ, র্যাব বা বিজিবি খুব সহজেই ডাকা যায়। তবে ওই পর্যায়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ কী জানেন? মানুষ কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে যে, আইনের কাছে আসতে হবে। যে কারণে খুব বেশি সময় কিন্তু লাগে না। আমাদের লোক যখন যায় তখন কিন্তু পুলিশ সাথে যায় না। সবাই তো সাদা রঙের মানুষ। আমরা তো নীল রঙের মানুষ নিয়ে ডিল করি না। সাদা রঙের সমাজের সম্মানিত মানুষ, হয়তো কাজের ক্ষেত্রে ভুল হয়ে গেছে কিংবা সচেতনভাবেই ভুল করেছেন। যারা ভুল করেন, তারা বুঝতে পারেন যে, যেহেতু আমি ভুল করে ফেলেছি, সেহেতু আমাকে যেতে হবে। প্রায়ক্ষেত্রে সবাই চলে আসেন।
প্রশ্ন: দুদকের সাথে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর সাপে নেউলে অবস্থা। তাদের দুর্নীতির ধারণা সূচক আপনারা মানেন না, আপনাদের সফলতার সমীকরণ তারা উড়িয়ে দেন- আসলে দুর্নীতির চেহারা বাস্তবে কি?
ইকবাল মাহমুদ: ধারণাগত ভুল ধারণা আছে এই বিষয়ে, টিআইবির সাথে আমাদের সাপে নেউলে সম্পর্ক না কিন্তু। টিআইবি কিংবা সুশীল সমাজের সাথে আমাদের সু-সম্পর্ক। হয়তো আপনারা দেখছেন, আমাদের কাজের কিছু সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনা হোক আমরা চাই। সমালোচনা না হলে আমরা আমাদের নিজের চেহারা তো দেখতে পারব না। আমরা সব সমালোচনাই ইতিবাচকভাবে নিই।
প্রশ্ন: এই প্রসঙ্গে মিডিয়ার ভূমিকা কী?
ইকবাল মাহমুদ: মিডিয়ার ভূমিকা সাংঘাতিক। আপনার মাধ্যমে সকল মিডিয়ার প্রতি ধন্যবাদ জানাতে চাই। প্রিন্ট ইলেক্ট্রনিক ও ফিল্যান্স সাংবাদিক সবাইকে ধন্যবাদ। গেলো এক বছরে সাংবাদিকদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি। দুর্নীতি করে যে পার পাওয়া যাবে না- এই বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। তাই মিডিয়াকে সবচেয়ে ভালো অংশীদার মনে করি।
প্রশ্ন: সর্বোপরি সাফল্য কী দুদকের?
ইকবাল মাহমুদ: এটা ভালো সূচনা। শুভ সূচনা হয়েছে। এটাই সফলতা। দুদক সম্পর্কে মানুষের একটা ধারণা ছিল, সেই ধারণা কিছুটা হলেও পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে- এটি বড় একটি সফলতা। আরেকটি সফলতা হলো- আমরা যে বার্তাটি দিতে চেয়েছিলাম, দুর্নীতি করে পার পাওয়া যাবে না- এই বার্তা আমরা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। আরেকটি সফলতা আছে- সেটি হলো শাস্তি, আমরা মামলা করি, মামলা করে আদালতে দিই, প্রমাণ করার চেষ্টা করি। অনেক সময় আমাদের সফলতার হার বিশ এ নেমে এসেছিল। এবার প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি ৫৪ শতাংশ। সুতরাং এটি কিছুটা বাড়ছে। মামলার গুণগত মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। আমরা নিজেরাও প্রশ্ন করি। আমি নিজেও দেখি- যে মামলা আসে অনেক প্রশ্ন করা যায় মামলার তদন্ত নিয়ে। তদন্তের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে- এটি স্বীকার করতে কোনো বাধা নাই। কারণ এটি পাবলিক প্রতিষ্ঠান। আমি মনে করি, কোনো কিছু গোপন না করাটাই ভালো। তদন্তে দুর্বলতা, জনবলের অভাব, নিজস্ব সাংগঠনিক সক্ষমতার অভাব আছে-এ সব বিষয়ে সরকারের সাথে দেনদরবার করছি। সরকার আমাদেরকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছে। তাই আমরা নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: সারাবিশ্বে দুর্নীতি বিরোধী দিবস, সপ্তাহ, র্যালি, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম- নানা আয়োজন থাকে। দুদক এর সচেতনতামূলক দিবস, ক্যাম্পেইনগুলোর প্রতিপাদ্য ও মটো নিয়ে কিছু জানতে চাই?
ইকবাল মাহমুদ: দুর্নীতি বিরোধী সপ্তাহ পালন করি- ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। ৩০ লাখ শহীদ, অনেক মা-বোনের সম্ভ্রম আর অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু যেমনটি বলেছিলেন- মুক্তির সংগ্রাম, আসলে সংগ্রামটা মুক্তির জন্যেই ছিল। সেই অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তি- আমরা পরিপূর্ণ সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি কি পেয়েছি? এটি একটি বড় প্রশ্ন। আসলে জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো প্রকার আন্দোলন, সংগ্রাম বা কোনো একটা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ফল লাভ করা সম্ভব না। জনগণকে সব কাজের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। এই চিন্তা ভাবনা থেকে আমরা ৭ দিনের একটি প্রোগ্রাম করি। কেন করি? মুক্তির কথা চিন্তা করেই করি। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখে- ওই দিন আমরা অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করি এবং বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করি জনগণকে বোঝানোর জন্য, জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য আমাদের নানা কর্মসূচী আছে। কিসের জন্য? দুর্নীতি জন্য।আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্যে। কারণ আপনি দেখেন আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় দশমিক পাঁচ বা সাত শতাংশ। এই বছর সাত দশমিক দুই শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে জিডিপির। দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিট হয়ে যাবে। দুই শতাংশ কমাতে পারলে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হবে। এই অর্থনৈতিক মুক্তির সাথে সামাজিক মুক্তি আর সামাজিক মুক্তির সাথে রাজনৈতিক মুক্তি- এই সব কিছুই আর্থিক বিষয় নিয়ে ঘুরপাক খায়। এই মুক্তির বার্তা দিতে আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছি।
প্রশ্ন: তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে কী ধরণের সফলতা এসেছে?
ইকবাল মাহমুদ: তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে খুব বেশি সফলতা এখনো আসেনি, কারণ আমরা মাত্র এর ব্যবহার শুরু করেছি। আপনারা জেনে খুশি হবেন, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক পাঁচ লক্ষ ডলার এবং কোরিয়ান সরকার ৩ লক্ষ ডলার দিচ্ছে- পেপারলেস অফিস অর্থাৎ আমাদের ডিজিটাল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্যে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্যে এই টাকা তারা দিচ্ছে। আমাদের যতটুকু সুবিধা আছে তাতে মনিটরিং করার সুযোগ পাচ্ছি। কতগুলো মামলা হচ্ছে. কতগুলো কোর্টে যাচ্ছে, কোনো মামলার সময় শেষ হয়ে গেলো, কোনো অনুসন্ধানের অগ্রগতি কী ইত্যাদি আমরা মনিটরিং করার সুযোগ পাচ্ছি তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে। এই মনিটরিং করার জন্য সাজার হার বেড়েছে।
প্রশ্ন: সাধারণ মানুষও দুর্নীতির কুফল ভোগ করে?
ইকবাল মাহমুদ: সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত নন কিন্তু দুর্নীতির কুফল তারা ভোগ করছে। দুনীতির ছিদ্র বন্ধ করা সম্ভব হলে সাধারণ মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে। এইটাই আমাদের মূল বিষয়। পুঁজিবাদী সমাজে এটি খুবই স্বাভাবিক যে, সম্পদ কুক্ষিগত হবে। কিন্তু তা যেন নিয়ম নীতির মাধ্যমে হয়। দুদকের বক্তব্যও তাই যে, সম্পদ কুক্ষিগত হোক কিন্তু তা সবাইকে দিয়ে হোক। অর্থাৎ আপনি ট্যাক্স ঠিকমত দিবেন, জনগণকে সেবা দিবেন। ধরুন, আপনি লোন নিয়েছেন খামার করার জন্যে, সেই লোন আপনি যদি খামার করতেন তাহলে মানুষের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু সেই লোন নিয়ে বিরাট এক বাড়ি করলেন, তাতে দেশের গরীব জনগণের আর্থিক কোনো সুবিধা হলো না। কিন্তু আপনার সুবিধা হয়েছে। যে কারণে দুর্নীতির জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ে। তাই দুর্নীতি কমলেই মানুষের ভেতরে বৈষম্য কমবে।