দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ উন্নতি হয়েছে বলে যেদিন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সেদিনই অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি দেশের গণমাধ্যমে দুটি খবর এসেছে; এক. প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে জয়পুরহাটে দুই দাখিল পরীক্ষার্থীর দুই বছর কারাদণ্ড এবং দুই. দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আলোচিত ৩০ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি।
টিআইয়ের করাপশান পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই-এর এই রিপোর্ট যেদিন বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হয়, সেদিনই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছেন দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।
আপাতদৃষ্টিতে এই খবরগুলো ইতিবাচক। কেননা এসব খবর পড়ে আমাদের মনে হতে পারে, প্রশ্নফাঁস হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটি প্রতিরোধে তৎপর এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সরকার আন্তরিক। শুধু সরকারি কর্মকর্তাই নয়, দুর্নীতির দায়ে খোদ সাবেক প্রধানমন্ত্রীরও সাজা হয় যা আইনের শাসনের একটি বড় সূচক। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে এত সরল উপসংহারে পৌঁছানো ঠিক হবে কি না, তা একটি বড় প্রশ্ন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে গত বছর সারা বিশ্বে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে উপরের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫ তম। এবার দুই ধাপ উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল। ২০০৬ সালে এসে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এক নম্বর থেকে তিন নম্বরে আসে। ওই বছরের সূচকে বাংলাদেশের নম্বর ছিল ২। এরপর ২০০৭ সালে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৭, ২০০৮ সালে ১০, ২০০৯ সালে ১৩, ২০১০ সালে ১২, ২০১১ ও ২০১২ সালে ১৩, ২০১৩ সালে ১৬, ২০১৪ সালে ১৪ এবং ২০১৫ সালে ১৩ নম্বর অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
বস্তুত দুর্নীতি একটি ধারণা বা পারসেপশন। যে কারণে টিআইয়ের এই জরিপের নামও করাপশান পারসেপশন ইনডেস্ক। যেমন ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে আসছি, পুলিশ ঘুষ খায়। কিন্তু এরপর জানা গেলো, শুধু পুলিশ নয়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী, শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি শিক্ষক-সাংবাদিকরাও নানাবিধ অনিয়ম দুর্নীতির সাথে যুক্ত। ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা মেরে দেন। তাছাড়া জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে লুটপাট ও দুর্নীতি এখন স্বতঃসিদ্ধ। ফলে এখন এ প্রশ্নটিই অধিকতর সঙ্গত যে, কোন খাত দুর্নীতিমুক্ত?…
রাষ্ট্রীয় সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্ভবত একমাত্র ফায়ার সার্ভিসের লোকেরাই ফোন পাওয়া মাত্রই ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভান এবং এর বিনিময়ে তারা নাগরিকদের কোনোরকম জিম্মি করে পয়সা নেন না। এর বাইরে সরকারের আর কোন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নাগরিকরা বিনা ঘুষে, বিনা তদবিরে, বিনা ঝামেলায় সেবা পান, তা বলা মুশকিল। তাহলে দুর্নীতি কমলো কোন জায়গায় ?
একজন লোক ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে পুলিশ কনস্টেবল হন, এএসআই হতে ১০ লাখ বা আরও বেশি। তাহলে ওই পুলিশ কনস্টেবল বা অফিসার মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে পয়সা খাবেন, তাতে বিস্মিত হবার তো কিছু নেই। ঘুষ ছাড়া একেবারে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি কেন সম্ভব নয়? কারণ, ওই ঘুষের টাকা শুধু একজন দুজনের পকেটে যায় না; এই টাকা রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে ভাগ-বাটোয়ার হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ঘুষের অর্থনীতির পরিমাণ কত, সেটি বের করা গেলে একটি বিশাল অংক দাঁড়াবে, যা দিয়ে হয়তো প্রতি বছরই একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
যে রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ একশো টাকা, সেখানে খরচ হয় তিরিশ টাকা। বাকি ৭০ টাকা কোথায় যায় তা সবাই জানে। নদী ভাঙন ঠেকাতে ব্লক ও বস্তা ফেলার নামে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও, অনেক সময়ই ব্লক ও বস্তা না ফেলেই বিল তুলে নিয়ে যায় ঠিকাদার। এখানে লাভ শুধু একা ঠিকাদারের নয়। ওই লাভের অংশ ভাগ হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, দলীয় ক্যাডার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রকল্প পরিচালকসহ নানা খাতে। সুতরাং দেশ থেকে এই ঘুষ ও অনিয়ম বন্ধ হয়ে গেলে অনেকেই আত্মহত্যা করবেন বলে ধারণা করা যায়।
ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, সরকার তাদের যে বেতন দেয়, সেটি বন্ধ করে দিলেও তারা যতটা না ক্ষুব্ধ হবেন, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবেন যদি তাদের ঘুষ বন্ধ করা হয়। কারণ প্রতিদিন তারা যে উপরি আয় করেন, অনেকের ক্ষেত্রে তা পুরো মাসের বেতনের সমান বা তার চেয়েও বেশি। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে ভূমি অফিসের দুর্নীতি বন্ধের হাঁকডাক করলেও কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে তা ভুক্তভোগীরাই জানেন।
দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকে টিআই-এর এই দুর্নীতির ধারণা সূচক সম্পর্কিত খবরের নিচে পাঠকরা যেসব মন্তব্য করেছেন, তার কয়েকটা এরকম:
১. মানুষ সরকারি অফিসে গিয়ে ঘুষ ছাড়া কতটুক সেবা নিতে পারছে সেটার আলোকেই বিচার করবে।
২. ভুমি কিংবা পুলিশ অথবা বিদ্যুৎ অফিসে ঘুষ লেনদেনে রাখডাকের ব্যাপার নেই।
৩. দুর্নীতি কমেছে বলা হয়েলও ঘুষ লেনদেনের বাস্তব চিত্র বেগতিক।
৪. তাহলে থানায় গেলে আর কাউকে টাকা গুণতে হবে না ? হয়তো স্বপ্নে !
৫. ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হওয়ার পরেও দুর্নীতি কমে কীভাবে?
রসিকতা করে একজন লিখেছেন: হা দুর্নীতি কমেছে! লোকাল এমপি, দলীয় লোক আর সরকারি কর্মচারীরা ঘুষ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে! প্রশ্ন পেতে টাকা লাগছে না! টাকা ছাড়াই চাকরি হচ্ছে! রডের বদলে আর বাঁশ ব্যাবহার হচ্ছে না! দুর্নীতি আসলেই কমেছে!!
দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের পারসেপশনে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তুলনাটা এরকম দেয়া যায়, একটি ক্লাসে একশোজন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে যার রোল নম্বর ছিল ১০০, এ বছর পরীক্ষায় তার রোল হয়েছে ৯৮। তো এটিকে আমরা উন্নতি বলব কি না? কারণ সে তো পাসের জন্য ন্যূনতম নম্বরই পায়নি।
সুতরাং, আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি এবং বিশাল বিশাল সেতু ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করছি বলে যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি, তা সবই বিফলে যাবে যদি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব না হয়। একটি জনবান্ধব সরকারের সামনে সব সময়ই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই দুর্নীতি রোধ করা। টিআইয়ের রিপোর্টে বাংলাদেশ এগোলো কি পেছালো, তার চেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষ প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির ভিকটিম হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)