একদিন দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে উঠে যে ভবনটি বছরের পর বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় সামাজিক অপরাধের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছিলো, কুখ্যাত সেই জনতা টাওয়ারই হয়েছে বাংলাদেশের আইসিটি বিপ্লবের নতুন স্বপ্নসারথি। জনতা টাওয়ার বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের অন্ধকার অধ্যায়ের এক বড় সাক্ষী হলেও সেই টাওয়ারকে কেন্দ্র করেই এখন হাজারো যুবক দেখতে পারবেন নতুন আলোর ঝলকানি।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রোববার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত যে জনতা টাওয়ারে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক উদ্বোধন করেছেন, সেই ভবনটির ইতিহাস কদাকার হলেও সেখান থেকেই নতুন যুগের সূচনা করতে চান অনেক উদ্যোক্তা।
‘এটাকে বরং অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা বলতে পারেন,’ বলে মন্তব্য করেন আইসিটি খাতে এক তরুণ উদ্যোক্তা।
তবে সম্ভাব্য উদ্যোক্তারা সবাই যে ভবনটির অন্ধকার দিকটি জানেন এমনও নয়।
অবৈধভাবে গড়ে উঠা জনতা টাওয়ার
এরশাদ আমলে মেসার্স জনতা পাবলিশার্স নামে এইচ এম এরশাদের একটি প্রতিষ্ঠান উত্তরা ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে ছয় কোটি টাকা ঋণ নিয়ে জনতা টাওয়ারের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলো আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ওই সময়ের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাড়াও তখনকার ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদও জনতা পাবলিশার্সের একজন মালিক ছিলেন।
কিন্তু জনতা টাওয়ারের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পরের বছর অবৈধভাবে জমি দখল করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার রায়ে এরশাদের কারাদণ্ড হলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার পাশাপাশি জনতা টাওয়ার বাজেয়াপ্ত হলে এটি সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
কংক্রিটের বস্তি জনতা টাওয়ার ছিলো অপরাধীদের আবাসস্থল
তবে, স্থানীয়রা বলছেন, দি্নের পর দিন মামলা চলার সময় রাজধানীর ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে অনেকটা বিষফোঁড়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিলো জনতা টাওয়ার। অত্যন্ত আধুনিক স্থাপত্যকলা ও শিল্পশৈলীতে নির্মিত ভবনটি দৈন্য দশায় পড়ে অনেকটা কংক্রিটের বস্তির রূপ নিয়েছিলো।
‘শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসী ও অপরাধ জগতের অনেক রাঘববোয়ালের জন্য এটা এক ধরণের উন্মুক্ত আবাসস্থল ছিলো,’ উল্লেখ করে স্থানীয এক ব্যবসায়ী বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধ এবং অসামাজিক কার্যকলাপেরও এক চারণভূমিতে পরিণত হয়েছিলো জনতা টাওয়ার।
এক/এগারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের অবসান হয়। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায়ই ছিলো এরশাদের স্বপ্নের এই ভবন।
যেভাবে জনতা টাওয়ারে টেকনোলজি পার্ক
বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন তার নানামুখি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০১০ সালের ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় জনতা টাওয়ারকে দেশের প্রথম সফটওয়্যার পার্ক হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে এরপরও ঝক্কি কম ছিলো না।
প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া শেষ করে জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক গড়ে তোলার দায়িত্ব পেয়েছিলো টেকনোপার্ক লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা শর্ত পূরণ করে যথাযথভাবে এবং নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার কারণে ২০১৩ সালে টেকনোপার্কের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে সরকার।
ক্ষুব্ধ হয়ে টেকনোপার্ক মামলা করলে ওই টেকনোলজি পার্ক সম্পর্কিত সব কাজে স্থগিতাদেশ দেন আদালত। অবশেষে দুই বছরেরও বেশি সময় পর গত ৯ সেপ্টেম্বর টেকনোপার্কের মামলাটি খারিজ হয়ে গেলে জনতা টাওয়ার টেকনোলজি পার্ক চালুর পথে বাধা-বিপত্তি দূর হয়।
একদিন সিলিকন ভ্যালির মতো বড় স্বপ্ন
জনতা টাওয়ার দেশের চতুর্থ সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক হলেও সরকারিভাবে এটাই প্রথম। এর আগে বেসরকারি পর্যায়ে অ্যাকসেঞ্চার, অগমেডিক্স এবং ডিজিকন নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে সফটওয়্যার পার্ক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ)।
নাগরিক সংহতির নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক ছাত্রনেতা শরিফুজ্জামান এ বিষয়ে চ্যানেল অাই অনলাইনকে বলেন, এটা (জনতা টাওয়ার) বেশ আলোচিত একটা ভবন। নানা আইনি জটিলতা পাড়ি দিয়ে দেশের আইটি খাত নিজের বিকাশের ইচ্ছা পূরণের একটা স্থায়ী জায়গা পেলো।
‘আমাদের দেশে এই খাতের বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, তার কিছু- পূর্ব শর্ত ও আছে। যার একটা হল পূর্ণ সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন একটা স্বতন্ত্র জায়গা। এর আগে ঢাকার কাছে একাধিক জাওয়ায় এ ধরনের পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটা আলোর মুখ দেখেনি। যে ভবনটিতে পার্কটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার পরিসর ছোট। প্রয়োজন এর থেকে আরো দশগুণ,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শরিফুজ্জামান বলেন: একইসঙ্গে ভালো যোগাযোগ সুবিধা, অবকাঠামো এবং ব্যব্স্হাপনা প্রয়োজন। মানুষ একটু একটু করে সামনে এগোয়। আমরা শুরু করলাম সেটা যতো ছোট সরিসরেই হোক। আশা করবো এক সময় আমরা এই ভিত্তির উপর সিলিকন ভ্যালি গড়ে তুলতে পারবো যদি আমরা আসলেই চাই।
আরো কয়েকটি টেকনোলজি পার্ক
জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক উদ্বোনের পর এখানে যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু অপেক্ষায় তখর আরো কয়েকটি এরকম স্থাপনা গড়ে তোলার কাজ চলছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক বাস্তবায়নের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিএইচটিপিএ। এর মধ্যে গাজীপুরে কালিকাকৈর হাইটেক পার্ক ও যশোরে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলছে।
এছাড়া, মহাখালী আইটি ভিলেজ, বরেন্দ্র সিলিকন সিটি রাজশাহী, ইলেকট্রনিক সিটি সিলেট, চন্দ্রদীপ ক্লাউড চর এবং চুয়েট আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর বাস্তবায়নের কার্যক্রমও চলছে জোরেশোরে।