চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

দুদকের তলব: বিপুল এবং মোতালেবদের সংবাদ যেভাবে বদলে যায়

কিভাবে শুরু করবো, বুঝে উঠতে পারছিনা। হতাশায় ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা। গণমাধ্যমের একজন কর্মী হিসেবে বিষয়টি লজ্জারও বটে। ঘটনাটি দুদকে একজন সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য দেয়া এবং গণমাধ্যমে ভুলভাবে খবরটি প্রকাশ ও প্রচার বিষয়ে।

আমি চ্যানেল আইয়ে কাজ করছি, সংবাদ বিভাগে, বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। তথ্য আদান-প্রদানের সুবিধার জন্য ফেসবুক মেসেঞ্জারে নিউজরুমের একটি গ্রুপ রয়েছে।

১৫ অক্টোবর, বৃহষ্পতিবার, আমার এসাইনমেন্ট ছিলো সচিবালয়ে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন ঘটনাবলী ফলো করা। কৃষিমন্ত্রী ডক্টর আব্দুর রাজ্জাকের একটি সংবাদ সম্মেলন ছিলো, বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপন বিষয়ে সরকারের প্রস্ততি সম্পর্কে জানাতে। তো ব্রিফিংয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে গেলাম, বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে ৩য় অবস্থানে চলে এসেছে।

সাথে সাথে খবরটি টিভি স্ক্রলে দিতে আমাদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে ঢুকলাম। একটা স্ক্রলের টেক্সট দেখে চোখ আটকে গেলো। আমার যে সহকর্মীটি দুর্নীতি দমন কমিশনের ঘটনাবলী ফলো করেন, তিনি একটি একটি নিউজ দিয়েছেন গ্রুপে-“অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক বিপুল কুমার গোস্বামী এবং উপ-সহকারী পরিচালক মোতালেব হোসেনকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ।”

নিউজটি পড়েই মনে হলো এই বিপুল কুমার গোস্বামী এবং মোতালেব হোসেন দুজনকেই আমি খানিকটা চিনি। খানিকটা বলছি এজন্য যে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে একবার তাদের সহযোগিতা পেয়েছিলাম। দুজনের মধ্যে বিশেষ করে বিপুল কুমারের নামটা আমার কানে বারবার বাজছিলো। কেননা, সে আমারই আরেক সহকর্মী রাহুল রায়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, বন্ধু। বছর দুয়েক আগে পাসপোর্ট অফিসে বিপুলের রুমে লম্বা আড্ডা দিয়েছিলাম। তরুণ কর্মকর্তা, যথেষ্ট চৌকস। খবরটার সাথে বিপুলকে মেলাতে কষ্ট লাগলো আমার। সাথে সাথেই ফোন দিলাম, নাম্বার বন্ধ। বিপুলের বন্ধু রাহুলকে ফোন দিয়ে কথা বললাম। তারও একই অনুভূতি, বিশ্বাস করতে পারছেনা। যাহোক, সচিবালয়ের কাজ শেষ করে চ্যানেল আইয়ে ফেরার পথে বিকাল পৌনে ৫ টার দিকে আবারো ফোন দিলাম, বিপুলকে। পেয়ে গেলাম। ও ফোন ধরেই হতাশা প্রকাশ করে বললো, “ভাই, আমি তো মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়ে গেলাম”। জানতে চাইলাম, আদতে কি ঘটেছে। বিপুলের বক্তব্য শুনে আমি হতবাক এবং লজ্জিত।

দুর্নীতি দমন কমিশন বিপুলকে ডেকেছিলো, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, রাজশাহীর একজন কর্মকর্তার দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে কি ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে, তা জানতে। ঐ কর্মকর্তা ঘুষ নিয়ে ভারতীয় নাগরিক হাফেজ আহমেদকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়েছে। আর গণমাধ্যমে, প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে, বিপুল কুমার গোস্বামী নিজেই দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। দুদক এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডেকেছে। মূলধারার টেলিভিশনে নিউজটি স্ক্রলে গেছে, অনলাইনে অনেকেই পড়েছেন নিউজটি। স্বজন, সহকর্মীদের কেউ কেউ বিপুলকে ফোন করে জানতে চেয়েছে, আদতেই সে দুর্নীতির সাথে জড়িত কিনা। বিপুলের জন্য সবচে কষ্টের ছিলো, তার বাবার ফোন পাওয়া। বিপুলের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান কাছের আত্মীয়, পরিচিতজনদের কাছে বিপুলের অবস্থানটা কি হতে পারে নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি আমরা।
বিপুল কুমার গোস্বামীর মতো, পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক মোতালেব হোসেনও ব্যথিত, ক্ষুদ্ধ। তার কথা, “ ভাই মান-সম্মান দেয়ার মালিক আল্লাহ, রক্ষাও তিনি করেন। মিডিয়ায় নিউজ দেখে আমাকে অনেকেই ফোন করেছে। আমারতো পরিবার আছে, বলেনতো তাদের কে কিভাবে মুখ দেখোবো?”

জানি, এই প্রশ্নের কোন উত্তর হয়না। সৃষ্টিকর্তার ওপর দায় চাপানো ছাড়া আর কিইবা করার আছে মোতালেব হোসেনের মতো ভুক্তভোগীদের। তিনি জানালেন, রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসের সেসময়ের সহকারী পরিচালক আবজাউল আলমের বিরুদ্ধে ভারতীয় নাগরিক হাফেজ আহমেদকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেয়ার অভিযোগ। জনাব আলম এখন বগুড়া অফিসে কর্মরত আছেন। তাদেরকে দুদক কার্যালয়ে ডাকা হয়েছিলো, অভিযুক্ত কর্মকর্তা, আবজাউল আলমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানতে।

আমার জানামতে প্রত্যেকটি সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল এবং টিভি চ্যানেলের নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতিমালা রয়েছে। চ্যানেল আইয়ের কথা বলতে পারি, আমাদের যেকোন নিউজ স্ক্রলে দেয়ার আগে বারবার ক্রসচেক করতে বলা হয়। চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ এবং প্রধান বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান নিউজরুমের দৈনন্দিন আড্ডায় বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সাথে হরহামেশা কথা বলে থাকেন। বিশেষ করে দুদকে অমুককে তলব, জিজ্ঞাসাবাদ- এ ধরনের স্পর্শকাতর নিউজ দিতে রিপোর্টারদের নিরুৎসাহিত করা হয়। দুদক কোন তথ্যের জন্য কাউকে ডাকলেই সেই ব্যক্তি দোষী হয়ে যাননা, এটা বুঝতে জ্ঞানী হওয়ার দরকার নাই। তারপরও স্পটে হিট অব দ্য মোমেন্টের চাপ সইতে না পেরে আমাদের অনেকেই ভুলটা করে ফেলি। আবার অনেক সময়, স্রেফ প্রতিযোগিতার দৌড়ে নিজেকে এগিয়ে রাখতে এধরনের স্পর্শকাতর নিউজ দিয়ে দেই আমরা। ডেস্কে দায়িত্বরতদের নজর এড়িয়ে কোন কোন সময় সেই খবরটি প্রচার এবং প্রকাশ হয়ে যায়। সংবাদকর্মী হিসেবে আমি, আপনি হয়তো তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। কিন্তু যাকে নিয়ে এধরনের ভুল-ভাল খবর প্রচার হয়ে গেলো, তার পরিবার, স্বজনের কথা কখনো কি ভেবে দেখেছি আমরা? আমার আপনার একটা মার মার কাট কাট নিউজের কারণে একজন মানুষ সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে কতোটা হেনস্তার শিকার হতে পারে ভাববার অবকাশ আছে কি আমাদের?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)