অবসরের আগেই বিচারপতিদের রায় লেখার বিষয়টিতে বিরোধীতা প্রথম আলোচনায় আসে আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার লেখা একটি চিঠিতে। সেখানে পেনশন সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রক্রিয়াকরণের জন্য অবসরে যাওয়ার আগেই নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর রায়ে সই করতে বলা হয় বিচারপতি শামসুদ্দিনকে।
পরবর্তীতে এই বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েক দফা চিঠি চালাচালির পর অবসরের পরে রায় লেখা নিয়ে তর্ক বিতর্ক জোড়ালো হয়, ১৯ জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতির এক বছর পূর্তি উপলক্ষে তার বাণীতে ‘কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী’ এমন মন্তব্যে।
বাণীতে প্রধান বিচারপতির এমন মন্তব্যে আইন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ ঝড় উঠলেও অনেকেই একে শুধু ‘প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, কোন রায় নয়’ বলে উল্লেখ করেন। জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় সরকারি দলের সদস্যরা বলেন, প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে এমন মন্তব্য যেমন অপ্রত্যাশিত; তেমনি এ মন্তব্য নিয়ে পানি ঘোলার চেষ্টাও অশোভন।
২২ জানুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ। বিএনপির পক্ষ থেকে এমন দাবি বেশ কয়েকবারই উল্লেখ করা হয়।
প্রধান বিচারপতির পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে চারদফা চিঠি চালাচালির পর এস কে সিনহার অভিসংসন চেয়ে গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী। ১৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন ঘটনাটিকে অশোভনীয় মন্তব্য করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে এটি উচ্চ আদালতে বিচার কাজে থাকা কোনো বিচারপতি আরেকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে লেখা চিঠির প্রথম ঘটনা।
পরবর্তীতে ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন দাবি করে তার পদত্যাগ চান শামসুদ্দিন চৌধুরী। ‘প্রধান বিচারপতি বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন।’ উল্লেখ করে সেদিন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবে না, এটা বহু আগে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, প্রধান বিচারপতি খালেদা জিয়ার মুখপাত্র হয়েই বিএনপির এজেন্ডা চরিতার্থ করার জন্যেই এটা করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমার রায় আমি দিচ্ছি, নথি আমি কেনো ফেরত দিবো। তার অবৈধ আদেশ আমি মানব না। এটা মহান সংসদও প্রত্যাখান করেছে যে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবে না।’
অবসরে যাওয়ার পর লেখা রায় গ্রহণ করার নির্দেশনা চেয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি দেন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী । তিনি বলেছিলেন, গ্রহণ করা না হলে তাঁর বেঞ্চে দেয়া সব রায় প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং দেশ বিচারিক ও সাংবিধানিক সংকটে পড়বে। সেই সাথে একটি দল এ বিষয়ে সামনের নির্বাচনে রাজনীতি করবে।
৭ ফেব্রুয়ারী তারিখে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে সংবাদ সম্মেলন করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগ করেন যে, তার প্রিজাইডিং জজ, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে তার লেখা সমাপ্ত হওয়া রায় এবং আদেশগুলো গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের লিখিত রায় ও আদেশ গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
তবে এস কে সিনহার কাছে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, সাবেক বিচারপতি এ.এইচ.এম শামসুদ্দিন চৌধুরী তার কাছে লিখিত রায় কিংবা আদেশ গ্রহণ করার জন্য জমা দেননি। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছিল, ‘প্রধান বিচারপতি আশা করেন, সাবেক বিচারপতি এ.এইচ.এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মিডিয়াতে মামলার রায় ও আদেশ সংক্রান্ত কোনো রূপ বক্তব্য না দিয়ে তার কাছে যতগুলো অনিষ্পত্তিকৃত রায়ের ফাইল রয়েছে, তা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিসে অতি সত্তর ফেরত প্রদান করবেন, যাতে বিচারপ্রার্থীদের আর ভোগান্তি না হয়।’
‘পেনশন সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে অবসরের আগেই সব রায়ে সই করে যেতে হবে’ বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান বিচারপতির পক্ষে এমন চিঠির জবাবে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি শামসুদ্দিন লিখেছিলেন, হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে তিনি সকল রায়ে সই করেছেন। আর যেহেতু একজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ার দিনও রায় দেন তাই সকল বিচারপতিই অবসরে যাওয়ার পর অনেক রায়ে সই করেন।
চিঠিতে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি লিখেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতির পেনশন তার কাজ শেষ করার ওপর নির্ভর করে বলে কোনো আইনি উপাদানের কথা যেমন আমার জানা নেই, তেমনই এটাও আমার জানা নেই যে রায় লেখা শেষ না করলে কোনো সহকর্মী বিচারপতির পেনশন আটকে রাখার জন্য প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিতে পারেন।
গত বছরের অক্টোবরে অবসরে যান আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। অক্টোবরের ১ তারিখে অবসরে গেলেও গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর শেষ কার্যদিবসে প্রথমবারের মতো আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিক কোন সংবর্ধনা ছাড়াই বিদায় নেন তিনি। পরে দ্রুত রায় লেখা এবং রায়ের নথি ফেরত দেয়ার জন্য কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয় সুপ্রিম কোর্টের রোজিষ্টার দপ্তর এবং শামসুদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে।
১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি তাঁর মন্তব্যের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তাঁর শপথ থাকে না। তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য। আদালতের নথি সরকারি দলিল। তাই অবসর গ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের কাছে সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করার অধিকার হারান। আশা করি বিচারকগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এমন বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকবেন।
এর তিন দিন পর ২২ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি আয়োজিত বার্ষিক নৈশভোজ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে একই মন্তব্য পুনর্ব্যক্ত করে প্রধান বিচারপতি বলেন, অবসরে যাওয়ার পর বিচারকদের আর কোনো পাবলিক ডকুমেন্টে হাত দিতে দেওয়া হবে না। অবসরে যাওয়ার পর বিচারকের রায় লেখার জন্য কেন ব্যক্তিগত ইন্টারেস্ট থাকবে। এটা কোর্ট দেখবে। এখানে একটা ভুল নীতি চলে আসছে। আর এই ভুল করতে দেয়া হবে না। আইনকে সমুন্নত রাখতে হবে। কোনোমতেই আইন এবং সংবিধান পরিপন্থী কোনো কাজ করতে দেয়া যাবে না’।
সেদিন পৌর সম্মেলন কেন্দ্রে এস কে সিনহা আরও বলেন, পৃথিবীর কোথাও এটা কল্পনা করা যায় না। আমরা এমন এক আজব দেশে আছি। বিচারকরা ছুটি হলে লন্ডন আমেরিকা সরকারি খরচে চলে যান। রায় লিখেন না। কিছু বিচারক আগে ভুল করেছেন বলে এখন আর একই ভুল করতে দেওয়া যায় না।