পোশাক খাত থেকে দুই বছরের মধ্যে শিশুশ্রম মুক্ত করার দাবি
চরম অব্যবস্থাপনায় কেরানিগঞ্জের পোশাক কারখানার শিশু শ্রমিকেরা: প্রতিবেদন
শিশুশ্রম নিরসনে ২০২২ সালের মধ্যে স্থানীয় পোশাক খাতকে শিশুশ্রম মুক্ত করার দাবি জানিয়েছে এ খাতের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। শ্রমিক নেতাদের এমন দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম।
রোববার রাজধানীর সোনারগাঁ হোটেলে শিশুশ্রম দূরীকরণে এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন (বিএলএফ)। ওই বৈঠকে এমন দাবি তোলা হয়।
‘স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানার শিশুশ্রম নিরসন: সমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক ওই আলোচনায় মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএলএফের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম আশরাফ উদ্দিন।
কেরানীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানাগুলোকে মডেল ধরে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিএলএফ।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে রপ্তানিকারক পোশাক শিল্পের পাশাপাশি খুবই নিরবে গড়ে উঠেছে স্থানীয় পোশাক কারখানা। বেশিরভাগ কারখানাই ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং সৈয়দপুরে অবস্থিত। এসব কারখানায় প্রস্তুতকৃত পোশাক দেশের স্থানীয় চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করে থাকে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের নিয়োগ, বেতন-বোনাসের ক্ষেত্রে কোনো আনুষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন মানা হয় না। ফলে এখানে আনুষ্ঠানিক চুক্তি, মাননম্মত কর্মঘন্টা এবং কাঠামোগত মজুরি নেই।
প্রতিবেদনে বিএলএফ জানিয়েছে, ইকোনোমিক সেন্সাস-২০১৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৬৫ হাজার পোশাক প্রস্তুতকারী ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে কেরানিগঞ্জে রয়েছে ৯ হাজার ৫শ কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পোশাকের প্রায় ১১ শতাংশ রপ্তানি করা হয়।
প্রতিবেদনে শিশু শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও মজুরির করুণ চিত্র তুলে ধরে উল্লেখ করা হয়, কেরানিগঞ্জে শিশু শ্রমিকেরা দৈনিক ১৩ ঘন্টা কাজ করে। তবে কাজের মৌসুমে তাদের কমপক্ষে ১৬ ঘন্টা করে কাজ করতে হয়। তাদেরকে মৌখিক চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে তারা নিয়মিত মজুরি পাচ্ছেন না। এছাড়া ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের শিক্ষানবিশ হিসাবে নিয়োগ দেয়া। ফলে দুই বছর তাদের কোনো মজুরি বা সুবিধা দেয়া হয় না।
এসব কারখানায় শ্রমিকদের কোনো ছুটি নেই। শ্রমিকেরা ‘কাজ নেই, বেতন নেই’ ভিত্তিতে কাজ করে। অর্থাৎ যেদিন কাজ করবে না সেদিন মজুরি পাবে না। শুধু তা-ই নয় কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত আলো, বাতাস, অগ্নিনিরাপত্তাসহ পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নেই।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বর্তমান করোনা সংক্রমণের সময় এসব কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। ফলে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শিশু শ্রমিকেরা। এসব কারখানায় শিশুর উপর যৌন নির্যাতন ও হয়রানি বেড়েছে। শিশুরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, কেরানিগঞ্জ এলাকার কারখানাগুলোতে শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু। এদের মধ্যে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার এবং ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার।
তবে এমন তথ্য নাকচ করেছেন সভায় উপস্থিত থাকা কেরানিগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জেল হোসেন।
তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জের কারখানাগুলোতে ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী কোনো শিশু শ্রমিক নেই। সেগুলোতে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ নারী শ্রমিক। শিশুশ্রম আমাদের এলাকায় আছে, সব জায়গাতেই আছে। তবে এই প্রতিবেদনে যেভাবে দেখানো হয়েছে সেভাবে নেই।
কিন্তু যথাযথ তথ্য উপাত্ত এবং নিয়ম মেনেই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ফলে প্রতিবেদনে দেয়া শিশু শ্রমিকদের সংখ্যাও সত্য বলে বিএলএফের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিশুশ্রম নিরসন করতে হবে।
তিনি কারখানা মালিক ও শ্রমিক নেতাদের কাছে শিশুশ্রম কবে নাগাদ শূন্যে নামিয়ে আনা যায় সেই বিষয়ে জানতে চান। এর উত্তরে শ্রমিক প্রতিনিধি ও কারখানা মালিকেরা জানান, ২০২২ সাল নাগাদ এ খাতকে শিশুশ্রম মুক্ত করা যাবে।
এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব বলেন, আমিও এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। ২০২২ সালের মধ্যে এ খাতকে আমরা শিশুশ্রম মুক্ত দেখতে চাই। আমাদের মন্ত্রণালয়ের কলেবর খুব স্বল্প। তবে আমাদের পরিধি অনেক বড়। প্রায় ৬ কোটি পরিবারের সঙ্গে আমাদের কাজ। এ স্থানীয় পোশাক খাতে প্রায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ নারী কর্মী এবং ৬০ থেকে ৪০ শতাংশ পুরুষ কর্মী আছেন। সেই হিসেবে এ মন্ত্রণালয় নারীর কর্মসংস্থান এবং ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে। আশা করছি, সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে এ খাতে শ্রম দেয়া শিশুদের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।
শিশু শ্রম নিরসনে প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। যেমন-
১. সরকার ঘোষিত বিপজ্জনক শিশুশ্রম তালিকায় স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানায় শিশু শ্রমিকদের অন্তর্ভক্ত করা।
২. শিশু শ্রমিকদের জন্য অ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৩. দক্ষতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া।
৪. শিশুশ্রম নিরসনে পিতা-মাতাকে সচেতন করে তোলা।
৫. স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানাকে ক্ষুদ্র শিল্প হিসাবে গণ্য করা।
৪. সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলোর নিয়মিত তদারকি বাড়ানো ও শ্রম আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া।
গোলটেবিল আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রেখেছেন, আইনজীবী সালমা আলী, বিএলএফের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম খান এবং মহাসচিব এ জেড এম কামরুল আনাম প্রমুখ।