জীবন নাকি জীবিকা- কোনটির অগ্রাধিকার? এমন প্রশ্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকা নিছক সময়ের অপচয়। প্রকৃতপক্ষে একটি অপরটির পরিপূরক। কলকারখানায় শ্রমিক যেমন চাই, তেমনি উদ্যোক্তাও অপরিহার্য। শ্রমে-ঘামে শিল্প যারা সচল রাখে, তাদের সবার উৎপাদন কর্মযজ্ঞ পরিচালনার দক্ষতা থাকে না। গবেষণায় মনোযোগ দেখা যায় না। দেশে ও বিদেশে বাজার অনুসন্ধানের তাগিদ থাকে না।
বাংলাদেশে এনজিও নামের প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে অঢেল অর্থ এনেছে গরীবের নামে, কিন্তু তার একটি অংশ দিয়ে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের কল্যাণ করেছে- এ অভিযোগ অনেকে করেন। কিন্তু তারা চাইলেই ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে না। বিদ্যানন্দ চালু ও সচল রাখাও সবার কাম্য নয়।
কোভিড-১৯, যা করোনা নামে পরিচিতি পেয়েছে- বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে অখণ্ড অবসর এনে দিয়েছে। আর তা প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি। সংবাদপত্রের প্রচার বিশ্বের সর্বত্র কমে গেছে। হকাররা প্রতিদিন বাড়ি যাবে পত্রিকা নিয়ে, সঙ্গে করোনা নিয়ে আসছে না তো- এ শঙ্কা প্রবল। অতএব, পত্রিকা বাদ। তাতে অর্থও বাঁচে। দিল্লিতে দেখেছি, হকাররা মোটর সাইকেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি যায়। আমি একবার যে দুটি বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম, একটিতে তৃতীয় ও অপরটিতে পঞ্চম তলায়। হকার রাস্তায় মোটর সাইকেলে বসেই নিখুঁত নিশানায় ব্যালকনিতে পত্রিকা ছুড়ে দিত। তার নিশানায় ভুল হয় কী-না, দেখার জন্য একাধিক দিন সাত সকালে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছি। ফল- আরামের ঘুমে ব্যাঘাত এবং উপলব্ধি- সব কিছু নিয়ে সন্দেহ করা ভাল নয়।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআিইয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তার একটি দাবি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি একটি অনুরোধ অবশ্য আমার মতো অনেককেই সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা যে অর্থনীতির নানা শাখা তছনছ করে দিয়েছে এবং সহজে তা থেকে নিরাময় মিলবে না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটা খুব দ্রুত উপলব্ধিতে নিতে পারেন। সেই ২৫ মার্চ তিনি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেন। প্রথম দিকে মালিকদের একটি অংশ ধরে নিয়েছিলেন, এ অর্থ পোশাক খাতের মালিকদের মধ্যে রিলিফের মতো বিলানো হবে। পরে অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়- যে সব কারখানা ভালো চলছে, শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ করে- তারাই এ সুবিধা পাবে। আর অর্থ মালিকের অ্যাকাউন্টে নয়, সরাসরি পাঠানো হবে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের নামে, বিকাশ বা অন্য মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। ফল- অনেক মালিকের মধ্যে হতাশা।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন শিল্প ও বাণিজ্য খাতের জন্য। পরের সপ্তাহে ঘোষণা দেন কৃষি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ। এ ছাড়াও কৃষকদের রাসায়নিক সার ও অন্যান্য উপকরণে ভর্তুকি বাড়ানো হয়। বোরো ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও নতুন করে নির্ধারণ করা হয়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রায় সব খাতকে কোনো না কোনো প্রণোদনা প্যাকেজে নিয়ে আসার কাজটি সময়মতো করা দূরদর্শিতার পরিচয়।
এসব হচ্ছে মূলত সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের কর্মসূচি। এর বাইরে বিশেষভাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হয়েছে। রিলিফ কাজ জোরদার হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা লাখ লাখ পরিবারকে দেয়া হচ্ছে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা। ঝড়-বন্যা কিংবা অন্য ধরনের দুর্যাগে সরকার কাজের বিনিময়ে খাদ্য কিংবা এ ধরনের কর্মসূচি বহু বছর ধরে চালিয়ে আসছে। কিন্তু করোনার ‘বিচ্ছিন্নতা’ তা অচল করে দিয়েছে।
করোনা বোরো ধান কাটা নিয়েও সংশয় তৈরি করেছিল। হাওরাঞ্চলে দেশের অন্য এলাকার চেয়ে সপ্তাহ দুয়েক আগে ধান পাকে। পাহাড়ি ঢলের শঙ্কা সেখানে প্রবল। লকডাউনের মধ্যে শ্রমিক মিলবে তো? দিনমজুর যদিও বা মেলে, তারা করোনা ছড়িয়ে দেবে নাতো? কিন্তু ভালো ভালোয় হাওরে ধান কাটা শেষ। ২০ শতাংশের মতো ধান কাটা হয়েছে আধুনিক মেসিনে। এটাও ভালো লক্ষণ। তবে দেশে বছরে যে চার কোটি টনের বেশি চাল-গম-ভুট্টার মতো খাদ্য শস্য জন্মে, হাওরে তার ১০ শতাংশও মেলে না। বাকিটা উৎপাদিত হয় অন্যান্য এলাকায়। এখন সেখানে বোরো ধান কাটার চ্যালেঞ্জ। এটা শেষ হতে না হতেই আউশ ধান ও পাট বীজ বপণ করতে হবে। তারপর আসবে আমন ধানের মৌসুম।
সবকিছু ছাড়িয়ে কৃষিতে আরও একটি উদ্বেগ- কৃষকরা প্রতি ৪০ কেজি ধানে সরকার নির্ধারিত ১০৪০ টাকা পাবে তো? না-কি তাদের কাছ থেকে ৪০ কেজি ধান ৭০০-৮০০ টাকায় কিনে সরকারকে ১০৪০ টাকায় গছিয়ে দেবে ধানের ব্যবসায়ীরা? যদি কৃষক ধানের বা চালের ন্যায্য মূল্য পায়- তাহলে রিলিফের ওপর চাপ কমবে, ১০ টাকা কেজি দরে চাল কেনার লাইন ছোট থাকবে, দারিদ্র্য সীমার নিচে নতুন করে লাখ লাখ নারী-পুরুষ চলে যেতে পারে বলে যে উদ্বেগ অর্থনীতিবিদরা প্রকাশ করছেন, সেটাও খানিকটা প্রশমিত হবে।
আমাদের শিল্প ও বাণিজ্য খাতের চেম্বার নেতৃত্ব, বুদ্ধিজীবী, প্রশাসন সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সচেতন। প্রধানমন্ত্রী জেলা পর্যায়ে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার কাজে সমন্বয়সাধনের জন্য এক এক জন সচিবকে দায়িত্ব দিয়েছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও উন্নত করে চলা, রিলিফ বিতরণ, প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ছাড়, শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান চালু বা বন্ধ রাখা, শিক্ষা কার্যক্রম- সব কিছুই এর আওতায় আসার কথা। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- প্রশাসনিক চ্যানেল ও গণমাধ্যম ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত দেশবাসীকে কার্যক্রম অবহিত রাখা। দেখা যায়, সরকার যে কাজ করে ফেলেছে- সেটা প্রচার না হওয়ায় অনেকে একই কাজ করার উপদেশ দিয়ে চলেছে।
লকডাউন অনেক এলাকায় কার্যত অচল- এমনটিই বলছে ফেসবুক, ইউটিউব ও গণমাধ্যম। সচিবরা কী বলেন এ বিষয়ে? লকডাউন যে সব এলাকায় শিথিল করা হয়েছে, কারখানা যেখানে বেশি সেখানে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে কী? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কিছু জানায় না। ধনীদের শীর্ষ চেম্বার এফবিসিসিআই বা প্রবল ক্ষমতাধর বিজিএমইএ নেতারা কিছু জানায় না। সংশ্লিষ্ট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবও কিছু জানান না।
ব্যাংকগুলোর উদ্বেগ- শিল্প-বাণিজ্য খাতে যে প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে, সে অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী সহজ শর্তে নামমাত্র সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ব্যাংকে অনেক ধরনের মানুষ অর্থ গচ্ছিত রাখে। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা আছে এমন অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। ব্যাংকগুলোতে মোট আমানত ১১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ১০ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়া আছে ঋণ হিসেবে।
খেলাপি ঋণের বোঝা প্রবল ভারি। গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে আছে। সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। তবে এ হিসাবে শুভংকরের ফাঁক আছে, এমন অভিযোগ অনেকের এবং তার সপক্ষে তথ্য-পরিসংখ্যান উপেক্ষা করা চলে না। আদালতের নিদেশে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায় কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এর পেছনে খেলাপি ধনিকদের কারসাজি আছে, এ সন্দেহ অমূলক নয়। ঋণের কিস্তি ও সুদ সময়মতো পরিশোধ না করে নানা কৌশলে পুনঃতফসিল করে নিয়েছে কিছু প্রভাবশালী লোক, এটাও আমাদের জানা। এভাবে সুবিধা নেওয়া হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণখেলাপিদের আসার কথা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে ও ব্যাংকের লোকদের ম্যানেজ করে যে সব ঋণ রিসিডিউল করে নেওয়া হয়েছে, তার পেছনে থাকা লোকেরা প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পাবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে? তার শিল্প ও বণিক সমিতির মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করছে। মন্ত্রিসভা ও সংসদে তাদের নিজস্ব লোক আছে। তাদের অনেকে ভাবতে পারেন, একবার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেই- পরিশোধের বিষয়টি পরে ভাবা যাবে। ফেরত না দিলেই বা কে কী করবে?
ব্যাংক কর্মকর্তা ও বোর্ডের পক্ষ থেকে ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ যথার্থ। যাদের ঋণখেলাপি হওয়ার ‘গুণ’ রয়েছে এবং এ জন্য শরম লাগে না, তারা দুঃসময়ে পাওয়া অর্থ নয়ছয় করবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়? কিন্তু তাদের উদ্বেগের একটি ‘জটিল কিংবা সরল’ ব্যাখ্যা কেউ এভাবে যদি করে- প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ব্যাংক ঋণ দেবে। কিন্তু প্রাপকদের একটি অংশ তা ফেরত দেবে না কিংবা সময়মতো ফেরতদানে গড়িমসি করবে। এমতাবস্থায় সরকার তাদের হয়ে ঋণ পরিশোধ করে দেবে। ব্যাংকগুলো এটাই তো চাইছে?
আমরা এটাও জানি, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রায় সবটাই এখন ধনবানদের নিয়ন্ত্রণে। ৭০ শতাংশের বেশি আমানত রয়েছে প্রাইভেট ব্যাংকে। যারা শিল্প বা বড় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিক, তাদেরই একটি অংশ ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক, চেম্বারের নেতাও তারা- করোনা প্রণোদনার অর্থপ্রাপ্তিতে তারা এগিয়ে থাকবে, সন্দেহ নেই। এদের একটি অংশ এটা চাইতেই পারে- প্রণোদনার অর্থ হাতিয়ে নেই দ্রুত, ফেরত দেওয়া না দেওয়া পরের কথা। ফেরত না দিলে তার দায় নেবে সরকার এবং সে অর্থ জোগান দেওয়া হবে রাজস্ব বাজেট থেকে, জনগণের পকেট থেকে শুল্ক-কর কেটে নিয়ে।
জটিল বিষয়টির খুব সরল ব্যাখ্যা হয়ে গেল কি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)