চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

দীপনকে নিয়ে লিখতে গেলে কলম আটকে আসছে…..

রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে শনিবার বিকেলে জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফীন দীপনকে দুর্বৃত্তরা জবাই করে হত্যার পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন আব্দুর নূর তুষার। সেখানে দীপনের সঙ্গে কাটানো বিভিন্ন সময়ের স্মৃতি তুলে এনেছেন। তিনি লিখেছেন,
‘দীপনকে নিয়ে লিখতে গেলে কলম আটকে আসছে।
দুই রাত ঘুমাই না।

গতকাল কাঁদতে পেরেছি, যখন জলির সাথে কথা হলো।

তারপর ….তাকে চিনি অনেকদিন।
তার পরিবার, পরিজন, বন্ধু ও আত্মীয়দের সাথে নানাভাবে আমি সম্পর্কিত। উদয়ন স্কুল, ফুলার রোড, বিশ্ববিদ্যালয়, আজিজ মার্কেট, বইমেলা, দীপন এর সাথে আমার কতো স্মৃতি।

দীপন আমার দুটো বইয়ের প্রকাশক। জোর করে বই দুটো প্রকাশ করেছিল সে। একটি বই আমার মাকে আর একটি আব্বুকে উৎসর্গ করা। বইমেলার ভীড়ে ঢুকতে পারছি না তাই দীপন হেঁটে এসে আমার বই এর প্রথম ৫ কপি পৌঁছে দিয়েছিল চাঁনখারপুল মোড়ে। বই পেয়ে আমার মা তাকে আলাদা করে তার কাছ থেকে বই কিনেছিলেন। আমার মায়ের কি খুশী, সেই খুশী উপহার দিয়েছিল দীপন। সেপ্টেম্বর মাসে আমার জন্মদিন। দীপন আর জলি এবছর তার বাসায় বিতর্ক প্রতিযোগিতার সাথে জড়িতদের দাওয়াত দিয়েছিল। তারপর হঠাৎ দীপন নিয়ে এল একটা কেক। আমাকে সারপ্রাইজ দিতে সে একসপ্তাহ আগেই আমার জন্মদিন পালন করছে। আমি আবেগে আক্রান্ত হয়ে বললাম, দীপন এত ভালবাসায় তো আমি মরেই যাব মনে হচ্ছে।

দীপন হেসে বলল, কে যে যাবে, সেটা তো আ্ল্লাহ জানে তুষার ভাই। দীপন তারপর সেলফি তুলতে শুরু করল। সে সেলফি ভাল তোলে না। তারপরেও একটা সেলফি সে তুলল তার বন্ধু বাবু আর আমার সাথে।
– স্মৃতিটা ভাল করে রেখে দেই তুষার ভাই। তারপর আমার প্রতি তার অভিমান।
– বিতর্ক নিয়ে আপনার বইটার প্রচ্ছদ বানিয়ে রাখলাম তিন বছর। আপনি বইটা দিচ্ছেন না। এবার আপনার কবিতার বই করবো। কবিতা আর বিতর্ক, একসাথে।

আমি সলজ্জ হেসে দীপনের অভিমান দুর করার চেষ্টা করছি। দীপন বলে, তুষার ভাই, আমি থাকতে আপনার বই আর কেউ প্রকাশ করবে না। করতে পারবে না। আমি বললাম, দীপন, বই প্রকাশ করতে তোমার টাকা বিনিয়োগ হয়। এতগুলি টাকা আটকে না রেখে তুমি আরো বেশী জনপ্রিয় কারো বই বের করো।

– আপনি তো আমার প্রিয় ভাই। জনপ্রিয় আবার কি জিনিষ?

দীপন এর অফিসে গেলেই জুস নিয়ে আসতো সে। নানা রকম ফলের রস। আজিজ মার্কেটে একটা দোকান আছে, সেখান থেকে। রোজার সময় বন্ধুদের সাথে একসংগে সে রোজা রেখে ইফতার করবে। আমাকেও দাওয়াত। নানা রকম জ্যুস।দীপন এত জ্যুস ? তোমার না ডায়াবেটিস?
তুষার ভাই রোজা রাখলে ডায়াবেটিস চলে যায়। আপনার নাম দিয়ে তাই সবরকম জ্যুস নিয়ে আসলাম। আসেন খাই। জলিকে কিছু বলবেন না।

দীপনের প্রকাশনায় হাজার রকম বই। রম্য রচনা, কৌতুক, রূপকথা, বাচ্চাদের বই । আবার আনিসুজ্জামান স্যার , সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও আছেন। দীপনের ইচ্ছা সে নানা রকম বই করবে। অভিজিৎ তার ছোটবেলার বন্ধু, উদয়ন স্কুল, ফুলার রোড এ তাদের সখ্যতা। তাই সে প্রকাশ করেছিল তার একটা বই। পেশাদার প্রকাশক নানারকম বই বের করে, তাই সে বইটা প্রকাশ করেছিল, কোন উদ্দেশ্য থেকে নয়। এই বইয়ের সাথে দীপনের নিজের বিশ্বাসের কোন সম্পর্ক ছিল না। সে তো ধর্মীয় বইও প্রকাশ করেছিল। তার দোকান থেকেই তো আমি কিনেছিলাম , মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর উপরে লেখা বই। সুফীবাদের উপর বই।

যে শুক্রবার দীপন আমার জন্মদিন উদযাপন করলো, সেদিনও সে নামাজ পড়ে আসল , নীল পাঞ্জাবী পড়ে। কি সুন্দর ছেলেটা, লম্বা, গৌরবর্ণ, হাস্যোজ্জল।

বড়ভাই এর চেয়েও বেশী সম্মান করেছে দীপন আমাকে।
একবার সে আমাকে বলছে তুষার ভাই আধ ঘন্টার মধ্যে আমার অফিসে আসতে পারবেন?
– কেন দীপন?
– আসেন না। তাড়াতাড়ি আসেন।
ফোনেই জোর করল সে।ভাবলাম না জানি কি জরুরী বিষয়।
– গিয়ে দেখি, আমেরিকা থেকে তার কয়েকজন বন্ধু এসেছে ।

আমি গিয়ে শুনি সে তার বন্ধুকে বলছে , দেখলা, আমি ডাক দিলেই তুষার ভাই চলে আসে ৩০ মিনিটের মধ্যে। সে বাজী ধরেছিল, আমাকে ৩০ মিনিটের মধ্যে হাজির করবে তার অফিসে। আমি চলে অাসাতে তার সে কি শিশুর মতো খুশী। হাসে আর বন্ধুদের বলে, বুঝলা, আমি কিন্তু দামী লোক। তোমরা সেটা বুঝতে পারো না।

তারপর আবার আমার পুরষ্কার, ফলের রস। এবার কিউইর রস। এটা নাকি সবচেয়ে দামী জ্যুস।

এই অক্টোবরেই আমি আর দীপন একটা দিন একসাথে ছিলাম। ওর মন খারাপ ছিল। ধুমপান ছেড়ে দিয়ে ইলেকট্রনিক সিগারেট খায়। সেটা খেয়েই চলেছে । রাগ করে ভাত খাবে না । ওকে ভাত খাওয়াতে ওর বাসায় গিয়েছিলাম। একসাথে খেয়েছিলাম। অভিমানী দীপন বাসাতেই থাকবে না। এত রাগ তার।খুব অভিমানী, রাগী দীপন, আমার সাথে শিশুর মতো হয়ে যেত। ওর দুই সন্তান আর ওর সাথে সেই রাতে খাবার সময় কি জানতাম, এটাই তার সাথে শেষ দেখা?

আমি দীপনের মরদেহ দেখতে যাইনি। আমি ভালোবাসার মানুষদের মরদেহ দেখিনা। আমার স্মৃতিতে কেবল তাদের জীবন্ত হাসিখুশী চেহারা থাকে। আমার কাছে দীপন তাই বেঁচে আছে। আমার হৃদয়ে। চোখ বুজলেই আমি দেখি সে হাসছে। আমি দেখি তার হাতে বই। দেখি সে বলছে, জ্যুস খাবেন তুষার ভাই। চলে আসেন।হাজার বইয়ের প্রকাশক দীপন। শিশুদের জন্য বই প্রকাশে তার অনেক আগ্রহ ছিল। টাকার জন্য অনেক স্বপ্ন থমকে থাকত। তারপরেও নতুন লেখকদের জন্য তার দরোজা খোলা।

যারা পিতা হয়েছেন, তারা জানেন, পুত্রের শরীরে সামান্য আঘাতে কি অসহনীয় বেদনা হয় পিতার।

কত রাত সামান্য জ্বরের কারনে জেগে কাটিয়েছেন পুত্রের শিয়রে। একমাত্র পুত্র, দীপনের চলে যাওয়ার বেদনা তবে কি ভয়াবহ তার পিতার জন্য। কি বিভৎস তার মৃতদেহ উদ্ধার করার স্মৃতি।

দীপনের বাবা তার হত্যার বিচার চান না।
কারণ দীপনের বাবা এই হত্যার কারনটিকে দুর করতে চেয়েছেন।
তিনি চেয়েছেন যাতে আর কোন পিতাকে এই বেদনার মুখোমুখি হতে না হয়।
আর কোন পুত্রকে রক্তাক্ত হতে না হয়।

তাই রাজনীতি ও ধর্মের নামে সংঘাত, বিভৎসতা, রক্তপাতের হাত থেকে আগামীর সন্তানদের রক্ষা করতে চেয়েছেন তিনি।
এটাই তো শিক্ষক ও পিতার কাজ।এই পিতারই তো পুত্র দীপন।

আর তাই সে বোঝেনি, তার বন্ধুর একটা বইয়ের জন্য তাকে এরকম মূল্য দিতে হবে। সে তো বন্ধুকে ভালোবেসেছিল। ভাইকে ভালোবেসেছিল। সে ভেবেছিল ভালোবাসা সব কিছু ক্ষমা করে দিতে পারে।প্রিয় দীপনক্ষমা করে দিও ভাই।আমরা ভালোবাসতে পারি না তো কি হয়েছে, তুমি তো পেরেছ। যে ঘৃণা তোমাকে কেড়ে নিয়েছে, সেই ঘৃণাকে তোমার জীবনে তুমি স্থান দাওনি।

জীবন ক্ষণস্থায়ী। তফাত কেবল আজ আর কাল। তুমি বিজয়ীর জীবন যাপন করেছ। তুমি শুধু ভালোবাসার কাছেই নত হয়েছে, হিংসা, ঘৃণা, অন্ধত্বের কাছে নয়।

আমাদের অন্ধকার, অপারগতা, অসহায়তা, ভীরুতা, অন্যায্যতা, অন্যায় এর জন্য তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিও।’