দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণীয় জাতীয় উদ্যান দিনাজপুরের ঐতিহাসিক রামসাগর দীঘি এখন জনশূন্য। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে তার আপন মহিমার অপরূপ সৌন্দর্য্য। দীঘির পানি, ফুল-গাছ, পাখি-প্রাণি ফিরে পেয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য আর স্বস্তি। মানুষের অনুপস্থিতিতে প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে প্রাণ, সেজেছে নতুন সাজে, আকঁছে নতুন আবহে, গাইছে যেন মুক্তি’র আনন্দ গান।
আড়াই শতাব্দির বেশি পুরনো দিনাজপুরের ঐতিহাসিক রামসাগর দিঘী। সাগর নয়, তবুও তার নাম রাম সাগর। অনাবৃষ্টির কারণে প্রজাদের চাষাবাদ ও পানির চাহিদা পূরণে মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫০-১৭৫৫ সালে খনন করেন এই রামসাগর দিঘী। প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক এ দীঘি খনন কাজ করেন। ১০৩১ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩৬৪ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই রামসাগরকে ২০০১ সালে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি দেয় সরকার।
দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষনীয় জাতীয় উদ্যান দিনাজপুরের ঐতিহাসিক রামসাগর দীঘি করোনার প্রাদুর্ভাবে এখন জনশূন্য থাকায় এখন আকাশের নিচে সবুজ গাছের সারি আর দীঘির শান্ত বহমান জলধারা। দীঘির শান্ত শীতল জলের বিশালতা, চারপাশের বৃক্ষরাজি ও প্রাণীকূলের অপরুপ সৌন্দর্য আকর্ষণ করতো দেশ-বিদেশের পর্যটকদের। আশপাশে ফড়িং এর আনা-গোনা। সাথে বিভিন্ন প্রজাতি পাখির অবাধ বিচরণ। এই চিত্রেই বলে দিচ্ছে মানুষের বাধ্যগত অবসরে প্রকৃতি কতোটা বিশুদ্ধ, কতোটা সুন্দর পরিবেশ। গাছে সবুজ পাতা, রঙ্গীন ফুল আর পাখিদের কলকাকলিতে এই উৎসব যেন রামসারগর দীঘি প্রকৃতিকে আকঁছে নতুন আবহে। এলাকার বাসিন্দারাও এতে যেন খুশি প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যে।
প্রকৃতির নিজস্ব একটা নিয়ম রয়েছে। প্রকৃতি সর্বদাই সুন্দর, সাবলীল ও স্বাধীন। করোনায় জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়লেও প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে তার সজীবতা। কৃত্রিমতা মানুষকে ঘরবন্দী করেছে। আর প্রকৃতি দিতে চলেছে তার সৌদর্য্য উজার করে। লকডাউন যেন এক যাদুর কাঠি। যার ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে প্রকৃতি। মনে হয় এ যেন এক অন্য ভুবন। করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রকৃতি কখনো নির্যাতন সহ্য করে না। একটা সময় সে সেটা ফিরিয়ে দেয়। তাই এই প্রকৃতিকে বাধ্য রাখতে রাখতে হবে পরিবেশ দূষনমুক্ত। আমরা প্রত্যেকেই যে যার মতো অবস্থানে থেকে প্রকৃতি রক্ষার কাজ করবো এটাই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।
করোনার কারণে পর্যটকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় জনমানবহীন ক’মাসে প্রকৃতি যেনো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। গাঢ় সবুজে মুগ্ধ রূপ ধারণ করেছে উদ্যানের প্রকৃতি। দীঘির পানিতেও এসেছে স্বচ্ছতা, ফুটছে শাপলা। মিনি চিড়িয়াখানায় অজগর সাপ ডিম পেরেছে। চিত্রা হরিণ নতুন ৯টি হরিণ শাবকের জন্ম দিয়েছে। রয়েছে এলামুন্ডা, থুজা, দেবদারু, সাইকাস, অপরাজিতা, নয়নতারা গোলাপ, সোনালু, ক্যাকটাস, জামরুল, হরতকি, পাল্ম, খেঁজুর সহ অসংখ্য উদ্ভিদ। উদ্ভিদের পরিচর্যাকারীরাও খুশি প্রকৃতির বহমান রূপ দেখে।
মাত্র কয়েকদিন আগেও প্রকৃতি ছিল শুস্ক, জীর্ণ-শীর্ণ। যেন বহু কালের ক্ষত-বিক্ষত পোশাক বদলে নতুন রূপে আজ প্রকৃতি। জেলার মিল-কারখানা,ইটভাটা আর যানবাহনের দূষিত বায়ু, অবহেলা-অবজ্ঞায় শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ। দিনে দিনে দূষণের পরিমাণ, ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। আর তাই যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ করোনা।
প্রকৃতির এই সৌদর্য্য ধরে রাখতে উদ্ভিদবিদ মো. মোসাদ্দেক হোসেন জানিয়েছেন নানা পদক্ষেপের কথা।
রামসাগর দীঘি জাতীয় উদ্যানের তত্বাবধায়ক মো. সাদেকুর রহমান জানিয়েছেন, রামসাগর দেখলে বিশ্বাস হয় না দিনাজপুরের প্রকৃতির আজ এই রূপ। তাই প্রকৃতি আজ আনন্দে আত্মহারা। দোল খাচ্ছে সবুজ পাতা, ফুলের ফাকে কিচির মিচির করে ঘুরছে, ফিরছে পাখি। প্রকৃতির নৈসর্গীক রূপ যেন এক নতুন জীবনের আহবান।
রাম সাগরের ৬৮ দশমিক ৫৪ একর পাড়ভূমি স্থলভাগ বন বিভাগের আওতায় এবং ৭৭ দশমি ৯০ একর জলভাগ দীঘি নিয়ন্ত্রণ করছে জেলা প্রশাসন।
বৈশিক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন,শোভা, সৌন্দর্য এবং স্বচ্ছতায় অতুলনীয় এই রামসাগর দীঘিটি তার ঐতিহ্য ধরে রাখুক এটাই প্রত্যাশা দিনাজপুরবাসীর। বহমান এই চিত্র ধরে রাখতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে কাজ করার পরামর্শ পরিবেশবিদদের।
করোনাভাইরাসের এই পরিস্থিতিতে মানুষ বাধ্যগত অবসরে থাকায়,প্রকৃতি তার প্রকৃত রূপ এবং সৌন্দর্য ফিরে পেয়েছে। প্রকৃতির এই বহমান রূপ ধরে রাখতে,প্রকৃতির পতি মানুষের বিরুপ আচরণ বন্ধ করতে হবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন প্রকৃতিপ্রেমি ও পরিবেশবিদরা।