পটুয়া কামরুল হাসানের চিত্রে যিনি ‘বিশ্ববেহায়া’, শাসক হিসেবে যিনি ছিলেন স্বৈরাচারী, নামের সঙ্গে স্বৈরাচার অভিধা যার প্রাসঙ্গিক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যার সময়ে ছিল রুদ্ধ সেই এরশাদের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু।
বার্ধক্যজনিত রোগে দীর্ঘ রোগভোগের পর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে সাবেক এই স্বৈরাচারের। মৃত্যু তারিখ ১৫ জুলাই, যদিও এর আগে তিনি ছিলেন লাইফসাপোর্টে। ওইদিন চিকিৎসকেরা তার মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন।
এরশাদের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকপ্রকাশ করেছেন। তাদের এই শোকপ্রকাশ যথাক্রমে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থাকে বিপথে কিংবা ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ায় ঠেলে দিয়েও এরশাদ তার মৃত্যুর পরেও পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সম্মাননা।
তার কফিন ছিল জাতীয় পতাকায় ঢাকা। অথচ এই বাংলাদেশের জন্ম ও সু-পরিচিতি প্রক্রিয়ায় এরশাদের কোন অংশগ্রহণ না থাকার পরেও তার এই সম্মানপ্রাপ্তি অস্বাভাবিক। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো সেটাই ঘটেছে, এবং সেটা রাষ্ট্রীয় ও সরকারি ব্যবস্থাপনায়।
এরশাদের মৃত্যুর পর মন্ত্রীদের কয়েকজন শোক প্রকাশ করেছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান অনেক নেতার শোকবার্তা ছড়িয়েও পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অথচ এই এরশাদশাহীর শাসনামলে গণতন্ত্রের জন্যে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ অনেকগুলো সংগঠন আন্দোলন করেছিল। অন্য অনেক রাজনৈতিক সংগঠনের মত আওয়ামী লীগপন্থী অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন, আহতও হয়েছেন শতাধিক।
আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, সিপিবি, জাসদ, বিএনপির নেতাকর্মীই কেবল এরশাদের রোষানলে পড়েননি; যারাই তার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বলেছে তারাই আক্রমণ, হয়রানি ও হতাহতের শিকার হয়েছে। এই তালিকায় অন্য অনেকের মত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাও। এরশাদের আমলে তিনি নিজে একাধিকবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তাকে হত্যার উদ্দেশে পরিচালিত সেই সব হামলায় নেতাকর্মীদের প্রাণের বিনিময়ে তিনি প্রাণে বেঁচেছেন।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে যে ১৯ হামলার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ সেই সব হামলার শুরুটা করেছিলেন এই এরশাদই। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে প্রথম আক্রান্ত হন শেখ হাসিনা। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আটদলীয় জোটের জনসভায় বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে জনসভাস্থলে যাওয়ার পথে শেখ হাসিনার ট্রাকমিছিলে সশস্ত্র হামলা হয়।
চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পাশে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহত হন ২৪ জন। ওই ঘটনায় শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করতে গিয়ে নয়জন নেতা-কর্মী নিহত হন। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড ছুড়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয় এই এরশাদের আমলেই।
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো সেই শেখ হাসিনা এই এবং সেই এরশাদের মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠান। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি তার শোকবার্তায় সংসদে এরশাদের ‘গঠনমূলক ভূমিকার’ কথা স্মরণ করেছেন। এই গঠনমূলক ভূমিকা কেমন গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের জনগণ দেখে আসছে। এই সময়ে রাজনীতিতে ডিগবাজির স্মারক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এরশাদের দল ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।
যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যায়নি, বরং কলঙ্কিত করেছে। এরশাদের দল গৃহপালিত বিরোধীদল এটা কেবল রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমালোচনাকারীরাই বলছে না, এটা খোদ জাতীয় পার্টির লোকজনই স্বীকার করেছে। পতিত স্বৈরাচারকে ক্ষমতা যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আদতে তাকে পুনর্বাসিত করেছে। এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় জেলে থাকা এরশাদ মুক্তি পান ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি।
চতুর এরশাদ এরপর আওয়ামী লীগ-বিএনপির দিকে মুলা ঝুলিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। নূর হোসেন, ডা. মিলনসহ অগণন গণতন্ত্রকামী শহীদের রক্ত ডিঙিয়ে আওয়ামী লীগও তাকে বুকে আগলে রেখেছে দীর্ঘদিন। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দিয়ে এরশাদ তার পুনর্বাসনের যে সিঁড়ি ডিঙিয়েছেন সেই সিঁড়ি ধরেই বাকি জীবনটা পার করেছেন নির্ঝঞ্ঝাট।
নিজের স্ত্রীকে দিয়েছেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসন, সংসদে বিরোধীদল থেকেও দলের নেতাদের দিয়েছেন মন্ত্রিত্বের স্বাদ, আর নিজেও হয়েছেন মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ দূত’।
বাংলাদেশের রাজনীতির দুষ্টক্ষত এরশাদ গণধিকৃত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, কিন্তু তার পতনের পর তিনি রাজনীতিতে লেনদেনের উপকরণ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে নিজের পুনর্বাসন কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। পতনের পর তার বিরুদ্ধে ৪২ মামলা হলেও সেগুলোর বিচার সম্পন্ন হয়নি। ফলে ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি যেমন ছিলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে, ক্ষমতা ছাড়ার পরেও একই। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
তাকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে লাভবান হয়েছে ঠিক তবে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়ে গেছে। গণধিক্কার পাওয়া সামরিক শাসক যেখানে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কথা তাকে সেখানে এভাবে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি আনুকূল্য প্রদানে দেশের ক্ষতিই হলো। কেবল আওয়ামী লীগই নয়, এরশাদের মৃত্যুতে অন্য দলগুলোর নেতাদের শোকবার্তাগুলোও হতাশাজনক।
আদালতের রায়ে দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন অবৈধ। তবে এই অবৈধ দুই শাসকের সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম এখনও টিকে আছে। একই সঙ্গে অবৈধ ওই সামরিক শাসকের একজন এরশাদ বৈধ সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রাপ্তও হয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে মূলত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এরশাদের সুসম্পর্কের কারণে। এই সম্পর্কে স্বীকৃত স্বৈরশাসক প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সংসদে কথিত গঠনমূলক ভূমিকার কারণে শেষবেলায় এসে পেল বিপুল সম্মাননা।
অথচ এই সংসদীয় ব্যবস্থার পুনর্প্রবর্তন হয়েছে এই এরশাদের পতনের পর, এবং সামরিকতন্ত্রের বন্দিদশা থেকে এই সংসদীয় গণতন্ত্রকে উদ্ধার করতে এই আওয়ামী লীগও আন্দোলন করেছিল, নেতৃত্ব দিয়েছিল।
এরশাদের জন্যে রাষ্ট্রীয়, সরকারি, আওয়ামী লীগ, বিএনপিদলীয় শোকসহ কিছু মানুষের শোকগুলো আমাদের পীড়া দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। রাজনৈতিক স্বার্থের এই শোকখেলায় প্রকৃতপক্ষে আমরাই পরাজিত, আর পরাজিত হওয়ার কথা ছিল যে স্বৈরাচারের সে বিদায় নিল বিজয়ীবেশে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)