চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

দায়হীনতার দেশে

গত ২০ মার্চ বণিকবার্তা পত্রিকায় ‘কেউ দায়ী নয়’ শিরোনামে সংবাদটি দেখার পরে ২০১১ সালে ভারতে মুক্তি পাওয়া ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ সিনেমাটির কথা মনে পড়ে; যেখানে দেখানো হয়, জেসিকা নামে একটি মেয়ে খুন হলেও কীভাবে ক্ষমতাবান খুনি বিচারের বাইরেই থেকে যায়। ১৯৯৯ সালে জেসিকা লাল নামে দিল্লির এক রেস্টুরেন্ট কর্মী ও মডেলের খুন হওয়ার ঘটনার আলোকে ওই সিনেমাটি পরিচালনা করেছিলের রাজকুমার বসু। আমাদের এখানেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি এবং কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে নিয়ে এরকম একটি সিনেমা হতে পারে। কারণ সাগর-রুনি হত্যার ৬ বছর এবং তনু হত্যার ২ বছরেও জানা যায়নি কারা তাদের খুন করেছে। ফলে একসময় হয়তো ওই সিনেমার মতোই আমাদের বলতে হবে সাগর-রুনি বা তনুকে কেউ খুন করেনি (নো ওয়ান কিলড দেম)।

বণিকবার্তার খবরটি অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গে। যেখানে বলা হয়েছে, রাজধানীর বস্তিতে নিয়মিত বিরতিতে আগুন লাগলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয় না। হতাহত হলেই কেবল মামলা হয়, তাও অপমৃত্যুর। এরও আবার তদন্ত হয় না। গত পাঁচ বছরে দেশের বস্তিগুলোয় ১ হাজার ২০০টির বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও একটিরও অভিযোগপত্র দাখিল করেনি পুলিশ। স্বাভাবিকভাবেই এসব অগ্নিকাণ্ডে কাউকে দায়ীও করা যায়নি। অর্থাৎ এখানেও বিষয়টি নো ওয়ান সেট ফায়ার টু দ্য স্লাম বা বস্তিতে কেউ আগুন দেয়নি। কিন্তু নিয়মিত বিরতিতেই এসব বস্তিতে আগুন লাগে, হাজার হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়, গরিব মানুষের থালাবাটি, কাঁথা-কম্বল ভস্ম হয়। দিনমজুরদের তিল তিল করে গড়ে তোলা সহায় সম্বল কয়লা হয়। কিন্তু কে আগুন দিলো, সেই মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না তনুর খুনিকে। যেমন অধরাই থেকে যায় সাগর-রুনির হত্যাকারী। শুধু তাই নয়, লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের ৬ বছরে তদন্তও শেষ হয় না।তনু হত্যা

বণিকবার্তায় যেদিন ‘কেউ দায়ী নয়’ শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশিত হয়, সেদিনই ছিল কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু হত্যার দুই বছর পূর্তি। সহপাঠীরা এদিনও ক্যাম্পাসে বিচার দাবিতে মানববন্ধন করেছে। শুধু তাই নয় যেহেতু আমাদের সবকিছুতেই প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হয়, সে কারণে সন্তান হত্যার বিচার দাবিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তনুর বাবা ইয়ার হোসেন। অভিযোগ করেছেন, বিচারে কোনো অগ্রগতি না হলেও তিনি ও তার পরিবার এখনও নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

তনুকে খুন করা হয়েছে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। ফলে বিষয়টি শুরু থেকেই স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্বভাবতই গণমাধ্যমও এই ইস্যুতে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে। কিন্তু বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইয়ার হোসেন বলেছেন, “সব আর্মি তো আমার মেয়েটাকে মারে নাই। আমি সব আর্মির কথা বলছি না। আমি বলি যে মারছে তার বিচারটা করেন”। মেয়েকে হারিয়েও শান্তিতে নেই এই পরিবার। তনুর বাবা বলেন, “ঘর থেকে বের হলেই একদল লোক আমার পিছনে পিছনে থাকে। কোথাও গিয়ে কথাও বলতে পারি না। আমি এমনকি ডাক্তারের কাছে গেলেও সেখানে গিয়ে তারা আমাকে বিরক্ত করে।” এই লোকগুলো কারা বা কারা তাদের সব সময় তনুর পরিবারকে নজরদারের ভেতরে রেখেছে? বোধ হয় তারা সেই ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’র ভিলেন, যারা আইনেরও বহু ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। সাগর-রুনির খুনিরাও বোধ হয় আইনের ঊর্ধ্বে। বস্তিতে আগুন লাগানো মানুষেরাও কি তেমনই?

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডবাংলাদেশে নিঃসন্দেহে অনেক এগিয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। উত্তরবঙ্গে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মঙ্গা নামে যে অভিশাপে প্রান্তিক মানুষকে না খেয়ে থাকতে হতো, সেই মঙ্গা এখন ইতিহাসের অংশ। দেশের কোনো প্রান্তেই এখন কেউ না খেয়ে থাকে বলে শোনা যায় না। খোলা জায়গায় মল ত্যাগ এখন কেউ করে না বললেই চলে। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় স্বল্পোন্নত দেশ এবং তার চার দশক পরে এসে উন্নয়নশীল হবার যোগ্যতা অর্জন একটি বিরাট ঘটনা। আয়তনে ছোট অথচ প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বিশাল চাপ মাথায় নিয়ে অর্থনীতিতে বাংলাদেশের এই অনন্য অর্জনগুলো ম্লান করে দেয় অপরাধের দায়হীনতার মতো ঘটনাগুলো। একটি অপরাধ সংগঠিত হবে, একজন মানুষ খুন হবে, বাসার ভেতরে, রাস্তার পাশে কিংবা সেনানিবাসের ভেতরে––অথচ খুনিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিংবা খুঁজে পাওয়া গেলেও তার পরিচয় বলা হবে না, তার বিচার হবে না; নিশ্চয়ই এর জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা দেশটাকে স্বাধীন করেননি।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরে দাঁড়িয়ে এখন এই দায়হীনতার (অপ) সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নো ওয়ান কিলড তনু অথবা সাগর-রুনি নিজেরাই নিজেদের খুন করেছেন এমন তত্ত্ব আমাদের শুনতে না হয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।