টানা দশ বছর ক্ষমতার বাইরে বাংলাদেশের একটি বড় দল বিএনপি। দশ বছরের এই ক্ষমতার নির্বাসন কতটা লাভ ও ক্ষতির কারণ হয়েছে বিএনপির জন্য? একইসঙ্গে তা দেশের জন্যই বা কেমন ভাগ্য বয়ে এনেছে?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সভাপতি বশির আহমেদের মতে, নিজেদের নীতি নির্ধারণে সমস্যা ও স্ট্র্যাটেজিক সমস্যার কারণে এই সময়ে এসে ফাইট ব্যাক করার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছে বিএনপি। সেই কোণঠাসা পরিস্থিতি থেকে নিজেদের ফিরিয়ে আনতে এখন যে পরিমাণ শক্তি ও পরিকল্পনা দলটির দরকার সেটাও তাদের নেই বলেই মনে হচ্ছে।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বিএনপি যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সেটা আমরা সবাই টের পাচ্ছি। এরকম জায়গা থেকে ফিরে আসার জন্য অনেকে অনেকরকম পদ্ধতি অবলম্বন করে। গঠনমূলক কিছু কর্মসূচী সামনে নিয়ে আসে। বিএনপিরও তৃণমূল পর্যায়ে সমর্থন আছে। তবে সেটা নিয়ে সেভাবে কাজ করতে পারেনি বিএনপি। যেমন রামপাল বিদ্যুৎ নিয়ে তারা কথা বলছে, সরকারের বিরোধিতাও করছে; কিন্তু সেক্ষেত্রে কোনো সমাধানযোগ্য বিকল্প তুলে ধরতে পারছে না। তারা এমন কোনো সমাধান দিতে পারছে না যেখানে বলা হবে, আমরা বিদ্যুৎও চাই আবার সুন্দরবনও চাই।
তার মতে, বিএনপির উপর বেশ ঝড় ঝাপ্টা গেছে, রাজনৈতিক দমনেরও শিকার হয়েছে। তবে তারা সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়েছে পলিসি, কমিটি ও স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সেজন্যই এতটা পিছিয়ে পড়েছে তারা।
একই কথা বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, বর্তমানে বিএনপি খুবই নাজুক অবস্থায় আছে সেটা আমরা সবাই জানি। এই অবস্থা থেকে যে তারা ফেরত আসতে পারবে সেই অবস্থাও তারা আর তৈরি করতে পারেনি। এইরকম অবস্থায় পড়লে অনেকে বেশ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেন। তারা সেটাও করতে পারেনি। এবারের বিএনপির সম্মেলনে তাদের কর্মীদের মধ্যে পুনরায় উদ্দীপনা ফিরবে বলে মনে করছিলো অনেকে। কিন্তু সেই আশাও ঠিক পূরণ হয়নি। নিজেদের নীতি-নির্ধারণে সমস্যা, কমিটির ভেতরকার সমস্যা এবং আরো নানান কারণে এখন বিএনপির অবস্থা পুরোই নাজুক। এই অবস্থা খুব সহজে তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে বিএনপি নেতা-কর্মীরা আশার আলো দেখছে না।
বশির আহমেদ বলেন, দশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি এখন একেবারে কোণঠাসা একটি দল হয়ে পড়েছে। আর এর ফলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছে সেটা হলো গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না। হচ্ছে না ইন্সটিটিউশন বিল্ডিং। বর্তমানে দেশ উন্নয়নের কাতারে আছে। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। মানুষতো এখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে সেই স্বপ্ন বুনছে মানুষ। বিএনপি সেভাবে তো কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারছে না এদেশের মানুষকে। এই অবস্থায় দলটিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে নীতি নির্ধারণে আরো পরিবর্তন আনতে হবে। অনেক শক্তিশালী ও তাৎপর্যপূর্ণ পলিসি নির্ধারণ করতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌসও মনে করেন, বিএনপির দুর্বলতায় সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছে তা হলো সংসদ ঠিকমতো কাজ করছে না। সেখানে যেন সরকার সমর্থিতরাই বিরোধী দল। ফলে কোনো সিদ্ধান্তেরই দ্বিমত বা আলোচনা সমালোচনা নেই। সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে ক্ষমতার ভারসাম্য হতো। আর ক্ষমতার ভারসাম্য হলে আরো সুন্দরভাবে রাষ্ট্র গঠিত হতো। এই দশ বছরের ফলে বিএনপির যে ক্ষতি হয়েছে সেই একই ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রেরও।
তবে ভুল করলে যেমন মানুষ অন্ধকারে ডুবে যায় তেমনই সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের পথেও এগোয়। নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিলেই কেবল এমন অবস্থা থেকে ফিরে আসা সম্ভব বলে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
উল্লেখ্য বিএনপি ২০০৬ সালে নির্বাচন নিয়ে ঐক্যমত তৈরিতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারায়। পরে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে পরাজয় বরণ করে বিরোধি দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এরপর ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে বিরোধি দলের অবস্থানটুকুও হারায়। এর মধ্যে কিছু আঞ্চলিক নির্বাচনে এই সরকারের অধীন অংশ নিয়েছে বিএনপি।