কে কোন দল-মত কিংবা আদর্শের উত্তরাধিকার সেটা ‘আপনার’ বিবেচ্য বিষয় নয় বলে কুষ্টিয়ার এসপি এস এম তানভীর আরাফাতকে সতর্ক করেছেন হাইকোর্ট।
ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্বরত সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণের জন্য সোমবার হাইকোর্টে হাজির হয়ে এই এসপি আইনজীবীর মাধ্যমে নিঃশর্ত ক্ষমা চান।
সেসময় বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এসপির উদ্দেশে করে বলেন, ‘পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া। সে যে–ই হোক না কেন। কুষ্টিয়ায় যে পরিবেশ বিরাজ করছে এবং পত্রপত্রিকায় যেভাবে তা এসেছে, সেটা যদি বাস্তব চিত্র হয় তবে তা ভয়ংকর।’
এসপি তানভীর আরাফাতকে হাইকোর্ট বলেন, ‘কে কোন দল-মত কিংবা আদর্শের উত্তরাধিকার সেটা আপনার বিবেচ্য বিষয় নয়। কথায় পটু হলে চলবে না, কাজে পটু হতে হবে। জেলার একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আপনার কার্যক্রমের মাধ্যমে সবকিছুর সমন্বয় সাধন করে কুষ্টিয়ায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করবেন, যাতে পুলিশ ভীতিকর না হয়ে বন্ধু হয়। আপনাদের (পুলিশের) মূলমন্ত্র হচ্ছে দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন। আপনাকে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আপনি রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছেন। সে পদকের মর্যাদা রক্ষা করা আপনার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোর (তিনটি বিভাগ) মধ্যে সমন্বয়সাধন করে কাজ করাকেই দক্ষতা বলে। আপনাদের কর্মকাণ্ডে মানুষের মনে এমন ধারণা যেন তৈরি না হয় যে একটি পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গেছে। আপনারা অনেক ভালো কাজ করেন। সে সব ভাল কাজ দিয়ে সমাজকে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যান।’
একপর্যায়ে এসপির বিষয়ে শুনানি শেষ করে আদালত আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন। সেই সাথে ওই সময় পর্যন্ত প্রিসাইডিং অফিসার শাহজাহান আলীর পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আর পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাতকে আপাতত হাইকোর্টে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আজ আদালতে পুলিশ সুপারের পক্ষে শুনানি করেন মুনসুরুল হক চৌধুরী ও আইনজীবী আহমেদ ইশতিয়াক।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাহিরুল ইসলাম। আর প্রিজাইডিং অফিসারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অনিক আর হক ও ইসরাত হাসান।
এর আগে সোমবার সকালে হাইকোর্টের তলবে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে এই পুলিশ কর্মকর্তা আদালতকে বলেন, ‘তিনি ওইদিন ম্যাজিস্ট্রেটকে চিনতে পারেননি। তাই অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে তিনি দায়িত্ব পালনে আরও সতর্ক হবেন।’
এ ধরনের ভুল আর কখনও হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসপি এস এম তানভীর আরাফাত বলেন, ‘বিচার বিভাগের জন্য আমার মনে সর্বোচ্চ সম্মান রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই বিন্দুমাত্র অসম্মান দেখানোর কথা দূরে থাক, বরং বিচার বিভাগের দেয়া কাজে নিয়োজিত হতে পারলে নিজেকে সম্মানিত বোধ করি। এঘটনায় আমি মনের গভীর থেকে অনুতপ্ত। আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
গত বুধবার বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত এক আদেশে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে কুষ্টিয়ার এসপিকে ২৫ জানুয়ারি সকালে হাজির হতে নির্দেশ দেন।
সেই সাথে নির্বাচনের দিনের ওই ঘটনায় কুষ্টিয়ার এই এসপি বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার কার্যক্রম শুরু করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। তিন দিনের মধ্যে এসপি এস এম তানভীর আরাফাতকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। হাইকোর্ট ওইদিন আদেশের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যিনি আইন ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বিচারিক দায়িত্ব পালন করছেন, তার সাথে পুলিশ সুপারের এমন আচরণ ও শব্দচয়ন গুরুতর আদালত অবমাননার সামিল। তার এই ধরনের আচরণ বিচার প্রশাসন তথা বিচার বিভাগের উপর মারাত্মক আক্রমণ।
সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর আরাফাতের প্রতি তার (এসপির) এই আচরণ এড়িয়ে যাওয়া যায় না এবং এটি হালকাভাবে নেয়া যায় না। কারণ তিনি (এসপি) শুধু আদালত অবমাননাই করেননি তিনি তার কথা ও আচরণের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন।’
গত ১৬ জানুয়ারি কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচন চলাকালীন ঘটনায় এসপি তানভীর আরাফাতের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা একটি আবেদনের কপি এর আগে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর পাঠানো হয়। এই আবেদনের অনুলিপি আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের আইজির দপ্তরেও পাঠানো হয়। সেই আবেদনে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসান বলেন, ‘কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনের সময় ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করি। সেখানে কয়েকজনকে ভোটকেন্দ্রের বুথের ভেতর পোলিং এজেন্টদের সাথে বসে থাকতে দেখি। তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে বললে তারা প্রিজাইডিং অফিসারের স্বাক্ষরিত এ ফোর সাইজের কাগজ দেখান। প্রিজাইডিং অফিসাসের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার সময় ওই কেন্দ্রে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত ৪০/৫০ জন ফোর্সসহ আসেন। তিনি প্রবেশ করেই প্রিজাইডিং অফিসারকে উচ্চস্বরে তলব করেন। সেসময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ফোর্স প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সাথে কথা বলতে না দিয়েই তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেন। একপর্যায়ে পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কে? কী করেন এখানে? আমি আমার পরিচয় দিলে তিনি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আপনি এখানে কী করেন? বেয়াদব, বের হয়ে যান। পুলিশ সুপার ও তার ফোর্সদের আক্রমণাত্মক, চরম অসৌজন্যমূলক ও মারমুখী আচরণে হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তখন দাঁড়িয়ে থাকি।এরপর এসপিসহ তার ফোর্সরা আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে উদ্দেশ করে একাধিকবার বলেন, এসব লোককে পাঠায় কে? বেয়াদব ছেলে। এখানে কাজ কী আপনার? বের হয়ে যান এখান থেকে। তারা কেন্দ্র থেকে চলে যাওয়ার পর আমি বিষয়টি ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করি।’