চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দল করছে, গঠনতন্ত্র মানছে না কেউ

রাজনৈতিক দলগুলোতে চলছে চরম হযবরল অবস্থা। দলের মূল চালিকা শক্তি গঠনতন্ত্রের ধার ধারছেনা কেউ। সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি)র কমিটি গঠন নিয়ে গঠনতন্ত্র অমান্যের ঘটনা প্রকাশ্য রূপ পেল। দলের কমিটি গঠনে গঠনতন্ত্র মানা হলোনা। বাস্তবিক কর্মকাণ্ডের সাথে মিলিয়ে গঠনতন্ত্র সংশোধনও করা হলোনা। গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত কমিটির মেয়াদও মানা হয়না। এক যুগের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়না। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বাম সবদলেই গঠনতন্ত্র অমান্যতার ঘটনা ঘটে চলছে। দলের ভেতরে গঠনতন্ত্র পঠন, অনুশীলন, চর্চা কিছুই নেই। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন কোন দলের কয়টি তা অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরাও জানেন না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষেত্রে এধরনের বেশি অনিয়ম প্রযোজ্য।

জাতীয়তাবাদী ও আওয়ামী শব্দ জুড়ে যে কেউ যেন যেকোনো সংগঠন গড়ে তুলতে পারে। যেমন জাতীয়তাবাদী সাইবার দল, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল, জাতীয়তাবাদী ফেসবুক দলসহ আরও কত কী। আসলে বিএনপিতে গঠনতন্ত্র সম্মতভাবে কয়টি ও কী কী নামে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন গঠন করা যেতে পারে এগুলো পরিস্কার করা উচিত। কেন্দ্রীয় কার্যালয় হতে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড কার্যালয় পর্যন্ত এসব অঙ্গ, সহযোগী সংগঠনের নামের তালিকা টানিয়ে রাখা যেতে পারে। ক্ষমতাসীন দলে অতি উৎসাহী লোকের কর্মকাণ্ড বেশি পরিলক্ষিত হয়। সরকার দল আওয়ামী লীগে অতি উৎসাহীরা বিভিন্ন সংগঠন গঠন করে আওয়ামী শব্দ জুড়ে দিচ্ছে। তৃণমূল আওয়ামী লীগ, ফেসবুক আওয়ামী লীগ, আওয়ামী ওলামা লীগ এমন কি ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তির নামের আগেও আওয়ামী শব্দ জুড়ে দিয়ে সংগঠন গড়ে তোলার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বাম দলগুলোতেও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলন হয়না অনেকের মধ্যে। তবে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে ততটা বিশৃংখলা নেই। কারণ তারা ক্ষমতার বাইরে বলে হয়ত এমনটি দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিকে ঘিরে থাকে কতিপয় সুবিধাভোগী পিএস, এপিএস ও পিএরা। দলকে ব্যবহার করে এমপি মন্ত্রী হয়ে দলীয় ত্যাগ তিতিক্ষার ভিত্তিতে অথবা দলের অনুমোদনে এই সুবিধাভোগীরা নিয়োগ প্রাপ্ত হয় না। মন্ত্রী এমপির ইচ্ছা অনিচ্ছাই এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রেও এবিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। বর্তমানে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদেও এরূপ আচরণের বহির্প্রকাশ ঘটছে। জাসদ ইনু ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে। অভিযোগ প্রকাশ পেয়েছে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী হওয়ার পরে দলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া কে কোনো কাজের দায়িত্ব না দিয়ে তার পছন্দে নিয়োগকৃত এপিএস, পিএদের দিয়ে দৈনন্দিন সকল কাজকর্ম করিয়েছেন। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা, সমালোচনা, আত্মসমালোচনা না থাকলেই দল ভাঙ্গে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মন্ত্রী হওয়ার পরে তার কাছাকাছি থাকা লোকদের বিষয়েও তৃণমূলে ক্ষোভের কথা শোনা যায়। বিভিন্ন জেলার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অনেকেই তৃণমূল বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছেন। দলের চেয়ে মন্ত্রীর আশপাশে থাকাটাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। জাতীয় পার্টিতে চেয়ারম্যানের ইচ্ছা অনিচ্ছাই চূড়ান্ত। না সরকারি দল না বিরোধী দলের গাছের খাওয়া ও গাছের তলের খাওয়ার চরম নির্লজ্জ সুবিধাবাদীর ভূমিকায় রয়েছে তারা। দলটিতে রয়েছে ভাঙ্গন ও বিশৃংখলা।এখানে গঠনতন্ত্রের ন্যূনতম কোনো চর্চা আছে বলে মনে হয়না। সবরকমের সমস্যাগুলো সমাধানের দায়িত্ব গঠনতন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত।

এক কথায় দলীয় শৃংখলা বজায় রাখতে সর্বরোগনাশী গঠনতন্ত্র রচনা ও তার প্রয়োগ চাই। এটি রচিত হয়ে দলে ক্রিয়াশীল হলেই শৃংখলা ফিরে আসবে। দল ক্ষমতায় গেলে বিশৃংখলা বেশি শুরু হয়। দলীয় এমপি, মন্ত্রী দলীয় ইমেজ, ভাবমূর্তি নষ্ট করলে কিংবা দলের উর্ধ্বে উঠে যাচ্ছেতাই করলে গঠনতন্ত্র দিয়ে তাকে প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা থাকা উচিত। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়ায় চেয়ারম্যানদের ক্ষেত্রেও এমনটি প্রযোজ্য। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দলীয় ও জনপ্রতিনিধিগত আচরণবিধি গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট থাকা প্রয়োজন। দলীয় সবকিছুতে গঠনতন্ত্রের হস্তক্ষেপ অনিবার্য থাকলে ও গঠনতন্ত্র সম্পর্কে নেতাকর্মীদের জানাশোনা থাকলে দলীয় বিশৃংখলা হ্রাস পেতে বাধ্য।

অতি উৎসাহীরা গঠনতন্ত্র পড়েও না। বুঝেও না। তারা ক্ষমতাসীন নেতা ও তার পরিবারের দৃষ্টিতে পড়ার জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যানার, ফেস্টুন টানিয়ে থাকে। অতি উৎসাহীরা ঝড়ের বেগে আসে আবার বানের জলে ডুবে যায়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনী গঠন ও পরে মুজিবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তার প্রমাণ। গোটা স্বাধীনতা যুদ্ধটাই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। এখানে আলাদাভাবে মুজিব বাহিনী গঠনের কী প্রয়োজন ছিল? এরপর কী দেখেছি। মুজিব বাহিনীর নেতারা দলে দলে জাসদে যোগদান করে মুজিবের বিরুদ্ধে চলে গেল। এরকম অতিউৎসাহী এখনও আছে। ক্ষমতাসীন পরিবারের ব্যক্তিবর্গের নামে সংগঠন, ক্লাব গড়ার তৎপরতা এখনও ক্রিয়াশীল রয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে, জিয়া সংঘ, জিয়া উত্তরসূরি ক্লাব ইত্যাদি নামে পাড়ায় মহল্লায় সাইনবোর্ড শোভা পায়। এখন তারা ক্ষমতার বাইরে থাকায় এইসব অতিউৎসাহীরা সেখানে নিরস্ত আছে। এখন সক্রিয় আছে সরকার দল আওয়ামী লীগে। মুজিব সেনা, মুজিব সংঘ, রাসেল উত্তরসূরি ক্লাব প্রভৃতি সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে আনাচে কানাচে।

এমন কি বিএনপি নেতা, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের গড়া তার মায়ের নামের কলেজ জোবাইদা রহমান মহিলা কলেজে সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব। ক্ষমতাসীন নেতা ও পরিবার তোষণ ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল সুবিধাভোগী অতি উৎসাহীদের মেধা ও মননে। নেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাহারি ব্যানার ফেস্টুন শোভা পায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এগুলোতে অতিউৎসাহীদের নিজেদের ছবি ও যে নেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই ব্যানার, পোষ্টার তার ছবি বড় করে থাকে। এগুলো নিয়ে কাউকে কাউকে বক্তৃতা বিবৃতি দিতে দেখা যায়। কিন্তু দূর করার কোনো প্রক্রিয়া নেই। বলা হয় হাইব্রিড নেতা। আর এদের মাঝে নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী নেতারা চাপা পড়ে যাচ্ছে।

দলীয় সদস্য পদ লাভ করতে হলে কতদিনের দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থাকতে হবে। অন্যদল হতে যোগদান করলে কতদিন পরে নেতৃত্ব লাভ করতে পারবে। এসব বিষয়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে গঠনতন্ত্রে। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় এমপি তার ইচ্ছেমত দলীয় কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বানিয়ে ফেলে। এমপি দলকে তোয়াক্কা না করে খেয়াল খুশিমতো চলতে থাকে। এগুলো প্রতিরোধ করতে হলে গঠনতান্ত্রিক ভূমিকার বিকল্প নেই। তা না করে দলীয় প্রধানের দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছুই হবেনা। দলীয় প্রধানের দেশের সকল কমিটি সম্পর্কে অবগত হওয়া ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এককথায় গঠনতন্ত্র, হ্যা গঠনতন্ত্রকেই সর্বময় কর্তৃত্ব দিতে হবে। তবেই দলগুলোতে নৈতিকতা ও শৃংখলা ফিরে আসবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)