চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে ওঠার দায় কার?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ব্যক্তিচর্চা রাজনীতির আদর্শিক গণতান্ত্রিক চেতনাকে নষ্ট করে দিচ্ছে৷ দলগুলো হতে পারছে না একেকটি আদর্শিক কর্মীবাহিনীর টিম৷ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে গড়ে তুললেন বিএনপি৷ এরশাদ গড়ে তুললেন জাতীয় পার্টি৷ বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী খন্দকার মুশতাকও কয়েক মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি হয়ে গড়ে তুলেন ডেমোক্রেটিক লীগ নামের একটি সংগঠন৷ ক্ষমতার বলয়ে থাকার সময়ে এসব সংগঠনে ডান বাম সর্বস্তর হতেই নেতাকর্মী যোগদানের হিড়িক পড়ে যায়৷ এক্ষেত্রে প্রশ্ন মুশতাক, জিয়া,এরশাদ রাষ্ট্রপতি না হলে কি এসব দলে কেউ যেতেন? দল গঠনের ভিত্তি তাই আদর্শিক না হয়ে ক্ষমতাই নয় কি?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন: শেখ হাসিনা নিজেই তার যোগ্যতা দিয়ে, দক্ষতা দিয়ে নিজেকে অতিক্রম করেছেন। শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে, গৌরব দিয়ে, তার সাহস দিয়ে, বিচক্ষণতা দিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন। আগে শুনতাম ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়৷ এখন তা উল্টে হয়ে যাচ্ছে। দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়৷

কী ঘটছে রাজনীতিতে? তোয়াজ আর তেলমর্দনে তা কি ক্রমশই জনগণের জন্য পিচ্ছিল হয়ে উঠছে না? এখন টাকা হলে মন্ত্রী-এমপি হওয়া যায়। টাকা হলেই সংগঠনের নেতা হওয়া যায়। আর মন্ত্রী-এমপিদের ঘিরে গড়ে উঠছে একশ্রেণির তোয়াজকারী ও চাটুকার চক্র৷ রাজনীতি হয়ে উঠছে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও উপার্জনের পথ৷ চলছে পদ-পদবী বেচাকেনা৷ নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য প্রভৃতি রাহুর মত ঢেকে দিচ্ছে রাজনীতির জনহিতৈষী আদর্শিক চেতনাকে৷ মন্ত্রী এমপিদের ঘিরে গড়ে উঠা তোয়াজকারী ক্ষমতাপূজকরা সবসময় ক্ষমতার পূজা করে নিজেদের আখের গোছাতে চায়৷ তারা সুসময়ে সরব থাকে দুর্দিনে নিরব হয়ে যায়৷ এখন রাজপথে হাটবাজারে ও অফিস আদালতে বিএনপির কোনো নেতাকর্মী পাওয়া যায় না৷

কাউকে জোর গলায় বলতেও দেখা যায়না যে সে বিএনপি করে। বরং উল্টো দলে দলে ক্ষমতার পূজো করতে তারা যোগ দিচ্ছে আওয়ামী লীগে৷ কিন্তু বিএনপি আবার ক্ষমতায় গেলে কি তারা ফের দলে দলে বিএনপিতে ফিরবে না? হয়তো অনেকেই এসে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বও নিয়ে নেবে৷ তারা চলে যাবে সামনের সারিতে আর দুর্দিনে লেগে পড়ে থাকারা পড়ে যাবে পেছনের কাতারে৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনটিই চলছে।

ওবায়দুল কাদের-সড়ক পরিবহন আইনসম্প্রতি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হলেন জয়নাল হাজারী৷ সেই খবরটিও দলটির সাধারণ সম্পাদক জানেন না৷ জয়নাল হাজারীও জোর গলায় বললেন এটা ওবায়দুল কাদেরের জানার বিষয় না৷ তিনি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়ে আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ জানাননি৷ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে৷ এভাবে ব্যক্তিকে দলের উর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দলটিকে? দুর্দিনে দল ও জোট, সুদিনে ব্যক্তি এগুলো কিসের আলামত? বিএনপি-জামাতের ৪ দলীয় জোট সরকারের দমনপীড়নের সময়ে রাজপথে নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা৷ জীবন দিয়েছিলেন আহসান উল্লাহ মাষ্টার, শাহ এম এস কিবরিয়া, স্বপন জোয়ার্দারসহ অসংখ্য নেতাকর্মী৷ এছাড়া কারাবরণ করেছে হাজার হাজার নেতাকর্মী৷ একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলায় যেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়, তখনো শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে মানব ঢাল হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই৷ তখন কিন্তু পুলিশ কিংবা আইনশৃংখলা বাহিনীর কেউ মানবঢাল হয়নি৷

২০১৪ সালে যখন নির্বাচন বানচালের ঘোষনা দেয় বিএনপি-জামাত জোট, দেশজুড়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবরোধ ডাকে তারা৷ শুরু হয় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সাধন৷ এমনই একটা উত্তপ্ত সময়ে গঠিত হয় নির্বাচনকালীন সরকার৷ এ সরকারে যোগ দেয় ১৪ দল ও মহাজোটের শরীকরা৷ এতে মন্ত্রীসভায় যোগ দেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ২০১২ সালে মন্ত্রীত্বের অফার ফিরিয়ে দেয়া ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও জাতীয় পার্টি(এরশাদ) এর আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ৷ তখন আওয়ামী লীগের বাইরের ১৪ দল ও মহাজোট নেতৃবৃন্দ নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ না দিলে নিশ্চয়ই সেই সরকার এক জটিলতার মধ্যে পড়তো৷ কারণ একদল নিয়ে নিশ্চয়ই নির্বাচনকালীন সরকার গ্রহণযোগ্য হতো না৷ আর শেখ হাসিনাও নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ব্যক্তি হিসেবে নয় দলের প্রধান হিসেবে৷ সুতরাং নেতৃত্বের শেকড় যে দলের ও দল নিয়ে গড়ে ওঠা জোটের এতে প্রশ্ন আছে কার? ব্যক্তির চেয়ে যে দল বড় এতে প্রশ্ন আছে কার?

ব্যক্তির দলের উর্ধ্বে উঠে যাওয়ার দায় নিশ্চয়ই দলেরই, সেটা ব্যক্তির নয়৷ আওয়ামী লীগ কি পারবে সে দায় অস্বীকার করতে? চেইন অব কমান্ড ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আদর্শিক পথে চললে নিশ্চয়ই এমন ঘটনা ঘটতো না৷ দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়েই হয়তো শেখ হাসিনা একক সিদ্ধান্তে এই অভিযান পরিচালনা করছেন৷ এই অভিযানে ভীত হয়ে উঠছে মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা৷ বিতর্কিত হচ্ছে রাজনৈতিক দল৷ চলছে মন্ত্রী এমপিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও বিদেশে যেতে নিষেধাজ্ঞা৷ এগুলোর দায় কি দলের নয়? শেখ হাসিনা কি ব্যক্তি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, নাকি দলের সভাপতি হিসেবে? যে দলের নেতাকর্মীরা তাকে সভাপতি বানালো সেই দলের নেতাদের বিরুদ্ধেই কেন তাকে অভিযান চালাতে হচ্ছে? কেন তাকে দল ঠিক করতে পুলিশি এ্যাকশন পরিচালনা করতে হচ্ছে? এর দায়ভার কি দল এড়াতে পারবে?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যখন প্রশ্ন করেন লোকমান এখনও কিভাবে বিসিবির পরিচালক? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি কার কাছে আশা করেন? বিসিবির সভাপতি একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভী রহমানের ছেলে পাপন৷ পাপন সাহেব কি দলকে উপেক্ষা করে তাকে পরিচালক বানালেন? আর যদি তাই হয় কেন বানালেন? এগুলো কি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সমন্বয়ের ব্যর্থতা নয়? যে অভিযান পরিচালনা হচ্ছে এর পরিণতি ভাল না মন্দ তাও শেষে বুঝা যাবে৷ তবে এর সমস্ত কৃতিত্ব অথবা দুর্নাম আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের ললাটে না গিয়ে যে শেখ হাসিনার দিকে যাবে, সেটাও পরিস্কার৷

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)