কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মানসী’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী/পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি/আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ/সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।/সঁপিয়া তোমার ’পরে নূতন মহিমা/অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।/কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না,/সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা,/বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,/চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।/লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,/তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।/পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা—/অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।’’
হ্যাঁ, কবিগুরুর ‘মানসী’র সূত্র ধরে বলা যায়, নারী যতটা ‘বায়োলজিক্যাল’, তার চেয়ে বেশি ‘সোশ্যাল’। বলা চলে নারী হচ্ছে পুরুষের ‘নির্মাণ’ বা সৃষ্টি। নারীকে এমন হতে হবে, এভাবে চলতে-ফিরতে হবে, ওভাবে ভাবতে-বলতে হবে, এটা এভাবে পরতে হবে-ইত্যাদি অসংখ্য সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে নির্মাণ করেছে পুরুষ। পুরুষের এই বেধে দেওয়া ছকের বাইরে গিয়ে অনেক নারীই দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তারা সংখ্যায় নগণ্য। বেশির ভাগ নারী এখনও পুরুষেরই ‘হাতে গড়া পুতুল’ হয়ে বেঁচে আছে, পুরুষের বেঁধে দেয়া ছক ধরেই টিকে আছে। এই ছক, এই অবয়ব প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা খুবই আস্তে আস্তে।
আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত মত হচ্ছে, পুরুষ মেধাবী, পুরুষ বোহেমিয়ান, পুরুষ সোনার আংটি। ও দিকে মেয়েরা? ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনের নিরিখে তাকে হতে হবে প্রকৃত সুন্দরী বা নিদেনপক্ষে সুশ্রী, মৃদুভাষী, গৃহকর্মনিপুণা, রুচিশীলা, ধারণ ও পালনে সক্ষম। এক কথায় সব। আদপে এ হলো ক্ষমতালিপ্সু পুরুষতান্ত্রিকতার এক ভীষণরকম ভিত্তিহীন হাতিয়ার। লিঙ্গ ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির বিধায়করা শুধু নারীর মর্যাদা ও অধিকার বোধকেই খর্ব করে না, একটা বিচ্ছিন্নকামী দেয়াল তুলে রাখে। সেই পুরাতন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত-ভোগবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা বরাবর ভোগের সামগ্রী বা পণ্য হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে এসেছে। হয়ে এসেছে পুরুষের ইচ্ছের পুতুল।
আমাদের ইদানিং সমাজ যতই আধুনিকমনস্ক হোক না কেন, আজও একটা না-বলা লুকোছাপা কাজ করে। নানা উছিলায় সমাজে ও পরিবারে কখনও ধর্মের নামে, কখনও নিয়ম-প্রথার নামে মেয়েদের নানা রকম শৃঙ্খলা ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে রাখার চেষ্টা হয়েছে এবং হচ্ছে। শিশু বয়স থেকে মেয়েদের পই পই করে শেখানো হয় বা শিখে নিতে হয়, পা ফাঁক করে বসবে না, জোরে কথা বলবে না, লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবে, অযথা বায়না করবে না। পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর থেকে অনুশাসন আরও জারি হয়। ছেলেদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করবে না, সদাসতর্ক হয়ে থাকবে, গা ঢাকা পোশাক পড়বে, সন্ধে বা ভরদুপুরে ফাঁকা রাস্তায় একা একা হাঁটবে না, একা একা ট্যাক্সিতে উঠবে না। এ সবই মেয়েটির ধর্ষিত না হওয়ার ধর্ষণজনিত সাবধানবাণী। মেয়ে তো, তাই সাবধান হতে হবে। সবসময় গা-বাঁচিয়ে চলতে হবে। এখনও এক শ্রেণীর মানুষ নারীকে কাঁটাতারের বেড়াজালে আটকে রাখতে চায়। কালো ধোঁয়া যেন অনবরত পাক খাচ্ছে মেয়েদের শুচিতার ওপর। এমনকি অনিচ্ছুক স্ত্রীকেও কতসময় বিপন্ন হয়ে স্বামীর কাছেই ধর্ষিতা হতে হয় বার বার। শয্যা সঙ্গী নিজের বিবাহিত স্বামীকেও হয়তো বলতে দ্বিধা করে যে আজ তার মন ও শরীর দুটোই স্বামীর ইচ্ছার সঙ্গে পাল্লা দিতে নারাজ। একটা অভিমানরূপী প্রতিবাদ চোরাগোপ্তা পথে আস্তে আস্তে ব্যবধান বাড়িয়ে তোলে দুজনের মধ্যে রঙ্গীন করে স্বপ্ন দেখা ভবিষ্যৎ তখন আবছা হয়ে আসে। যমুনায় শ্যামের বাঁশি বাজলেও তা আর রাইয়ের কানে পৌঁছায় না। আবার নারী নির্যাতনের ঘটনাবহুল খবর বা ধর্ষণের রগরগে খবর যখন সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনের পর্দায় রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করা হয়, কিছু মানুষ কেমন উৎসুক হয়ে সেই সমস্ত খবর সম্পর্কিত দৃশ্য দেখে অথবা ছাপার অক্ষরে পড়ে। নারীদেহ নিয়ে, নারীর শুচিতা নিয়ে লালসা বা আগ্রহ কোনও কিছুরই অভাব থাকে না তখন।
এটাও বহু যুগের অভ্যস্ততার ফল। পুরুষরা যুগযুগান্তর ধরেই নারীকে কামসঙ্গী হিসেবে ভাবতে ও ভাবাতে অভ্যস্ত। মুনিঋষিরা কামতাড়িত হলেই অন্য মুনির স্ত্রীকে সঙ্গমে ডেকে নিতেন। নিজেদের চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে পুরুষরা ইচ্ছেমতো খোলস বদলে দেয় নারীর। কখনও সে দেবী তো কখনও সে সেবাদাসী। নারী যেন সম্পূর্ণই পুরুষের ইচ্ছের প্রতীক এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজসৃষ্ট, যাকে ধর্মের মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে নারীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মেয়েদের দেবী সাজানোর মিথ্যা আশ্বাসে কখন সেবাদাসী, দেবদাসীর ভূমিকায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
আদি প্রস্তর যুগে সমস্ত পুরুষজাতির কাছে নারীই ছিলেন অলৌকিক দেবীস্বরূপা। এমনকী সন্তান জন্মের রহস্যকেও বলা হত দৈব-জাদু। নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো। কৃষি যুগ শুরু হওয়ার পরই ফসল উৎপাদনের সঙ্গে নারীর সন্তান প্রজননের এক যোগসাজশ পুরুষের কাছে উন্মোচিত হল ক্রমশ।
অচিরেই পুরুষ আবিষ্কার করল নারী সন্তান ধারণের উপযুক্ত ক্ষেত্রভূমি। এই উর্বর ক্ষেত্রকে উৎপাদনের মাধ্যম করে তুলল পুরুষ। নারীকে সন্তান উৎপাদন ও সন্তান পালনের জন্য পণ্য মনে করা শুরু হতে লাগল। এটাই ছিল পুরুষের সমাজ গঠনের একটা ধরণ। একসময় যেখানে নারীকে শস্যদাত্রী হিসেবে দেবীরূপে বন্দনা করা হত, তার পাশাপাশি নারীকে ভোগের পণ্য করে তোলার চতুর পন্থা শুরু করলেন সেকালের যজমান-পুরোহিতরা। তাদের নিদান ছিল অধিক ফলন। নারীর ভূমিকা পরবর্তী সময় সংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষতন্ত্রে ও সমাজে ধর্ষণ প্রতিশব্দে অজান্তেই কখন জড়িয়ে গেল।
হিন্দুপুরাণে নারীর প্রধান ‘অষ্ট গুণ’ চিহ্নিত ছিল। প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, এই গুণ আরোপ করেছিলেন ভোগসর্বস্ব বহুস্বর পুরুষরাই। সেখানে নারীর কী কী গুণ থাকতে হবে তার সুচারু ভাবচিত্র কল্পনা করে বলা হয়েছে-‘‘কার্যেযু দাসী, করণেষু মন্ত্রী,/ভোজেষু মাতা, শয়নেষু রম্ভা,/রূপেষু লক্ষ্মী, ক্ষমায়েষু ধরিত্রী,/সৎকর্মে নারী, কুলধর্মে পত্নী।’’এই সমস্ত শাশ্বত হিন্দুবাদী রূপক পেরিয়ে এসে এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের সমাজ যতই আধুনিক হোক না কেন-নানা উছিলা ও বিধিনিষেধ নারীর ওপর আজও বিদ্যমান। সমাজে রক্ষণশীল মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়ে গেছে আজও। তাই এখনও ব্যাপক সংখ্যায় বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। লিঙ্গ নির্ধারণ পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে কণ্যা ভ্রুণ হত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। শুধু তাই নয়, বিবাহিতদের ত্রয়ো চিহ্ন শাখা-সিঁদুর-মঙ্গলসূত্র থেকে স্বামীর মঙ্গলার্থে বার-ব্রতপালনের হিড়িক দেখা যায়। ধর্মে নারী রয়েছে দাসের ভূমিকায় আর পুরুষ প্রভুর। মনুর বিধান হিন্দুদের এক অলঙ্ঘনীয় বিধান। সেখানে আছে, “পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।/রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা না স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যহর্তি।’’ অর্থাৎ নারীকে পিতা রক্ষা করবে কুমারী কালে, স্বামী যৌবনকালে, বার্ধক্যে পুত্ররা, স্ত্রী মানুষ স্বাধীনতার যোগ্যই নয়। পুরুষরা নারীকে শিক্ষিত হিসেবে দেখতে চায়। আবার ‘গৃহকর্মে নিপুণা’ও চায়। ভাবনাটা অনেকটা এমন যে- নারীরা শিক্ষায়-দীক্ষায় পুরুষদের সমকক্ষ হতে সচেষ্ট না হয়ে, মানুষ না হয়ে, নারী হিসেবেই তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করুক। নারীর শিক্ষা হবে একটি খণ্ডিত মানুষে পরিণত হওয়ার শিক্ষা। যে শিক্ষা আবর্তিত হবে গৃহকর্ম, রন্ধন, সেলাই, সহ্যগুণ, লজ্জা, সেবা, আচার ইত্যাদি বিষয়ে উৎকর্ষ লাভের মধ্য দিয়ে।
যদি আমরা দৈহিক ভিন্নতাকে অস্বীকার না করে দেহকে প্রাধান্য না দিয়ে একটু ভাবি তাহলে নারীরাও একজন পরিপূর্ণ মানুষ, তারও নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, চেতনা, সৃষ্টিশীলতা, ব্যক্তিত্ব, বিবেক-বুদ্ধি-সম্মান রয়েছে, স্বাধীনতা রয়েছে, তাতে অযথা হস্তক্ষেপ না করে তাকে জীবনের পথে চলার অঙ্গ/সাথী বলে যদি ভাবতে পারি হয়তো শ্লীলতাহানি, যৌন নির্যাতন, মেয়ে হিসাবে জন্মানোর জন্য নিপীড়ন, ধর্ষণ বা পারিবারিক নির্যাতনের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারি।
এ জন্য নারী দিবস নয়, বরং একটা পুরুষ দিবস দরকার, যে দিবসে পুরুষরা ঘোষণা করবে তাদের নতুন ইশতেহার। নারী হিসেবে, ‘অর্ধেক মানবী’ হিসেবে, পণ্য বা ভোগের বস্তু হিসেবে নয়, নারীকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবার এবং নির্মাণ করার অঙ্গীকার পুরুষরা যেদিন ঘোষণা করবে, সেদিনটাই কেবল তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে নারীর জন্য দিবস পালন। তাহলেই কেবল সম্ভব মানুষ হিসেব নারী-পুরুষের সমতা ও সমমর্যাদার সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)