বাংলাদেশে এই প্রথম। ৭১ সালে তার বয়স ছিল চার। ২০১৭ সালে ‘মুক্তি’ নামের শর্টফিল্ম করতে গিয়ে একটি জাতির জন্ম যন্ত্রনার নির্মমতা জেনেছিলেন তিনি। ফলে দেশটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশী দেশ হলেও আসা হয়নি ‘লগন’ অভিনেতার। এবার আসা হল নিজের পেশাগত কর্মকান্ড নিয়েই। বাংলা ভাষার সিনেমায় অভিনয়। প্রথমবারের মত। নিজের দেশ ভারতের বাংলাভাষি অংশ পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় নয়। একেবারে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে গড়া দেশ বাংলাদেশের সিনেমায়।
যে সিনেমা গড়ে উঠেছে এদেশের জন্মযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ ৫২ এর ভাষা আন্দোলন নিয়ে। আর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তৈরী স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা ‘ফাগুন হাওয়ায়’ পাকিস্তানি নির্মম পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। টানা ১৫ দিন। ১০ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ। তিনি খুশি ২৬ মার্চ থেকে আর এমন খল চরিত্রে নিজেকে সঁপে দিতে হবে না। তার মতে ছবিটি মুক্তির পর সবাই তাকে ঘৃণা করবে।
এই তিনি যশপাল শর্মা। যার পুরো ভারত জুড়ে চলছে ১১টি মঞ্চ নাটক। আর বলিউডে চলছে নানা ধরণের সিনেমায় অভিনয়। ‘লগন’, ‘রাউডি রাঠোর’, ‘গঙ্গাজল’ কিংবা ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ এর অভিনয়ে তার বৈচিত্র বোঝা যায়। স্বাধীনতার দিনে এসেছিলেন চ্যানেল আই কার্যালয়ে। নিজের চলচ্চিত্রের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সম্পর্তে জানতে কিংবা বাংলাদেশ ছাড়বার আগে একদিন ঢাকা শহরকে দেখবেন বলে এই আসা।ৎ
ইমপ্রেস সম্পর্কে তার অভিমত, ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠানে গিয়েছেন সিনেমার কাজে কিংবা সিনেমার বাইরে কিন্তু এমন আন্তরিকতা ভালোবাসা মেলেনি। ‘কেমন লাগল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় করে কিংবা বাংলাদেশী অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করে?’ কনফারেন্স রুমের আড্ডায় উঠে আসা প্রশ্নে আন্তরিক ভঙ্গিতে সমীহ মাখানো স্বরে বলেন: এ ছবিটা অস্কারে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে এটা আমি দিল থেকে বলছি। পাশাপাশি বাংলাদেশের সিনেমাকে ভিন্ন উচ্চতায় নেবার সামর্থ্য আছে সিনেমাটির। কি অসাধারণ গল্প। আমাকে ইংরেজী করে পুরো সিনেমার চিত্রনাট্য পাঠিয়েছিল পরিচালক তৌকীর। পুরো স্ক্রিপ্ট না পড়ে আমি সাধারণত কোন সিনেমা করিনা। পুরো স্ক্রিপ্ট পড়ে মনে হল হাসির আড়ালে কি অদ্ভুত ভাবেই না ইতিহাসের সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে।’
একটু থেমে যশপাল বলেন: আবুল হায়াত স্যার, ফজলুর রহমান বাবু, রওনক অথবা সাচ্চু এরা দারুন শক্তিমান অভিনেতা। তিশার অভিনয় আমি এখানে আসার আগে দেখেছি। এখানে এসে কাজ করে দেখলাম সে দারুন সুন্দরী এবং গুণী অভিনেত্রী। সিয়াম অনেকদূর যাবে।
চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগরের শ্বেত শুভ্র উপস্থিতি ওজন বাড়িয়ে দেয় আড্ডার। যেন কতদিনের চেনা যশপাল তার। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, খাবার খাওয়া হয়েছে কিনা? তারপর যশপালকে স্বাধীনতা দিবসে ফল খাবার আমন্ত্রণ জানান। তারপর হঠাৎই প্রশ্ন ছোটে: বলত এই ফল খাবার আমন্ত্রণের মাহাত্ম কি? যশপাল সামান্য সময় নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন: ২৬ ধরণের ফল রয়েছে নিশ্চয়! যেহেতু আজ ২৬ মার্চ!’ কতটা তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি হলে এমন উত্তর দেওয়া যায়!
ভাষা আন্দোলনের চলচ্চিত্র যেহেতু সেই আন্দোলনের মিনার নিজ চোখে না দেখলে কি হয়? তার খুবই ইচ্ছা শহীদ মিনার দেখবেন। যশপাল বলেন, ‘এতদিন ধরে বাংলাদেশে কাজ করছি কিন্তু ঢাকা দেখা হয়ে ওঠেনি। এমন দিনে ফ্রি হলাম যেদিন তোমদের স্বাধীনতা দিবস। আমার দারুন সৌভাগ্য। শহীদ মিনার দেখতে চাই।’
হরিয়ানার যশপালের পরণে লাল পাঞ্জাবী আর সবুজ ওড়না জড়ানো গলায়। যশপাল জানান বিষয়টা কাকতালীয়। কিন্তু রাস্তায় লাল সবুজের ছড়াছড়ি দেখে তিনি আপ্লুত। গাড়ি ছোটে শহীদ মিনারে। শহীদ মিনারে গান চলছে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/ রক্ত লাল রক্ত লাল। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তারপর বললেন, গানের কথা ও সুরগুলোতে কেমন যেন ভেতরে টগবগ ফুটেছে।’ অর্থ জেনে বললেন, নিজের ভেতরে বিপ্লবী বোধ কাজ করছে। তোমাদের আবেগের জোর অসাধারণ।’এবার গাড়ি ছুটে চলে শিল্পকলার দিকে। শিল্পকলার মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ কিংবা শিল্পকলার বিভিন্ন রসের সামান্য আস্বাদ নেওয়ার ইচ্ছা তার। তবে বড় ইচ্ছা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের চিত্রকলা প্রদর্শনী স্বচক্ষে দেখা মুক্তিযোদ্ধা চিত্রশিল্পী শাহবুদ্দিনের অনবদ্য রং তুলিতে ভিন্নমাত্রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান উদ্ভাসিত। শিল্পকলা একাডেমীর চিত্রশালায় চলছে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের একক চিত্রপ্রদর্শণী। অভিভূত যশপাল ঘুরছেন প্রদর্শনী কক্ষ। দেখছেন। তুলছেন ছবি। অনুভব করছেন রং তুলির বলিষ্ঠ টান। দেখা শেষে বিদায়ের পালা। সন্ধ্যা গড়িয়ে নামছে শহরে। বের হবার মুখে শিল্পীর বড় একটি ছবি। তার পাশে গিয়ে দাড়ান আরেক শিল্পী। অভিনয়ের। একটু নিচু হয়ে তোলেন ছবি। একজন প্রকৃত শিল্পীই সম্মান জানাতে পারে তার অগ্রজ শিল্পীকে।