তোফাজ্জল ভাই, হাজার কথা বলার ছিল আপনার সাথে। আপনার বাসায় যাব। দিন কাটাবো। শুনব আপনার সংগ্রাম মুখর জীবনের কথা। আপনার লেখালেখির গল্প। কার্টুন আঁকার ইতিহাস। আপনি কীভাবে ‘তোফা’ হয়ে উঠলেন সে গল্প শুনব। যাই যাচ্ছি করে যাওয়া হলো না।
আমাদের অকারণ নাগরিক ব্যস্ততায় টেলিফোন ছাড়া আপনার সঙ্গে যোগাযোগও ছিল না। ফোন দিতেন প্রায়ই। নানা স্বপ্ন ও কর্ম প্রবাহের গল্প বলতেন। আপনি শয্যাশায়ী ছিলেন। একটি সড়ক দুর্ঘটনা আপনার জীবনকে সংকুচিত করে তুলেছিল। মূল ঢাকার সন্নিকটে আমিনবাজারে ছোট্ট একটি বাড়ি গড়ে তুলেছিলেন। সেখানেই প্রায় নির্বাসনে শেষ দিনগুলো কেটেছিল আপনার। লিখতেন। ছবি আঁকতেন। বই পড়তেন। টেলিফোনে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এক অন্যরকম মানুষ ছিলেন আপনি। আমাদের সময়ের হিরো।
খুব নিপাট সাধারণ জীবন যাপন ছিল আপনার। তোফাজ্জল ভাই- কত স্মৃতিই না আপনাকে ঘিরে।
কোনটা রেখে কোনটা বলি। উদ্যোগী, কর্মবীর এক মানুষ ছিলেন আপনি। অনেক ধরনের কাজ করতেন। অর্থ উপার্জনের বুদ্ধিমত্তা আপনার ছিল না। শুধু কাজ আর কাজ। স্বপ্ন আর স্বপ্ন। স্বপ্নের পেছনেই আপনার শ্রম।
আমাদের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয় ১৯৭৮ সালে। কোনো এক শুক্রবার সকালে। কবিবন্ধু আহমাদউল্লাহ আমাকে নিয়ে গেল। অনুশীলন সংঘ। প্রতি শুক্রবার সেই সংঘের উদ্যোগে শিশু কিশোর উপযোগী সাহিত্য সভার আয়োজন করা হতো। এই সভার উদ্যোক্তা ও পরিচালনা করতেন শেখ তোফাজ্জল হোসেন।
আমাদের প্রিয় তোফাজ্জল ভাই। আমাদের গড়ে ওঠার প্রথম সিঁড়ি ছিল অনুশীলন সংঘ। সবাই খাতায় নাম এন্ট্রি করে লেখা পাঠ করতো। তারপর সেই লেখা নিয়ে আলোচনা। এভাবেই আমাদের শিশুমন গভীরভাবে সাহিত্যপ্রেমী হয়ে ওঠে।
অনুশীলন সংঘের প্ল্যাটফর্মেই পরিচিত হই তৎকালীন নবীন প্রবীণ লেখকদের সাথে। সেদিন যারা ছিলেন সম্ভাবনাময় তরুণ তারাই আজ দেশের প্রতিষ্ঠিত লেখক। তোফাজ্জল ভাই- এই অনন্য সাফল্যের কৃতিত্ব আপনার। অনুশীলন সংঘে যারা নিয়মিত আসতেন তাদের নামের তালিকা অনেক দীর্ঘ হবে। স্মৃতি থেকে কিছু নাম উল্লেখ করতে চাই যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অনুশীলন সংঘে।
সুকুমার বড়ুয়া, আবু সালেহ, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন, আবদুর রহমান, আবু হাসান শাহরিয়ার, লুৎফর রহমান রিটন, সৈয়দ আল ফারুক, সৈয়দ নাজাত হোসেন, আহমদ মতিউর রহমান, তুহিন রহমান, আনিস রহমান, শাহাবুদ্দীন নাগরী, আসলাম সানী, ফারুক হোসেন, ফারুক নওয়াজ, আহমাদ মাযহার, আলীমুজ্জামান, অজয় দাশ গুপ্ত, সেলিম নজরুল হক, লেলিন চৌধুরী, শাহানাজ কালাম, ইসমাইল হোসেন, উৎপলকান্তি বড়ুয়া, আবু সাইদ জুবেরী, মাহবুবা হক কুমকুম, সৈয়দ সায়েম, নাসরিন
২
জাহান, বাপী শাহরিয়ার, মহিউদ্দিন আকবর, আলী ইমাম, হাসান হাফিজ, নাজমুল ইসলাম বাবুল, মঈনুদ্দীন খালেদ, মনজুরুর রহমান, রোকেয়া খাতুন রুবী, আবু মুসা চৌধুরী, হাসনাত আমজাদ- এরকম অনেক নাম। কারও সাথে বন্ধুত্ব। কেউ বা ঈষৎ অগ্রজ। সত্তরের শেষভাগে আশির মধ্যভাগ পর্যন্ত
আমরা তোফাজ্জল ভাইকে ঘিরে ছিলাম অনুশীলন সংঘে। আর অনুশীলনে যাদের সংগে দেখা হয়েছে তাদের সংগে আত্মীয়তার বন্ধন আজও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
শয্যাশায়ী হয়েও অনুশীলন সংঘের প্রাক্তনীদের নিয়ে আবার সক্রিয় হতে চেয়েছেন। সবাই মিলে জেগে উঠতে পারিনি বলে অনুশীলন সংঘ নবপর্যায়ে সফল হতে পারেনি। এই দায়ভার আমাদের সকলের।অনুশীলন সংঘ ছিল পাঠশালা। সাহিত্যের কলকব্জা ও খুঁটিনাটি আমরা জেনেছি এখান থেকে। শিক্ষক সাংবাদিক, ব্যাকরণবিদ, অর্থনীতিবিদেরাও আসতেন এখানে। তারা অনেক জটিল বিষয়কে সহজে উপস্থাপন করতেন আমাদের সামনে। অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে এক ধরনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল অনুশীলন সংঘ। এখানেই প্রথম পরিচয় অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লেখক সাইয়ীদ ফেরদাউস প্রমুখের সাথে।
তোফাজ্জল ভাই- প্রতিষ্ঠিতদের মধ্যে কবি আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী প্রমুখকে নিয়মিত পেয়েছি। আপনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঐতিহ্যবাহী ‘সবুজ পাতার’ সম্পাদক ছিলেন। চাকরিসূত্রে আপনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলী কিংবা নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ এর সঙ্গে।
তোফা ভাই নিয়মিতভাবে পত্রপত্রিকায় কার্টুন আঁকতেন। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি নিয়মিতভাবে দৈনিক বাংলায় আপনি কার্টুন আঁকতেন। বাংলাদেশের কার্টুন জগতের ইতিহাসে আপনার আগমন প্রথম দিকে। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক কাজী আবুল কাশেমের প্রচ্ছন্ন প্রেরণায় আপনি কার্টুন চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। কাজী আবুল কাশেম ‘দোঁ পেয়াজা’ নামে অবিভক্ত বাংলায় কার্টুন আঁকতেন।
ইলাস্ট্রেশনও করতেন। তারই প্রভাব তোফা’ ভাই আপনার ওপর ছিল। আপনিও অনেক বইয়ের কার্টুনধর্মী ছবি এঁকেছেন। পাকিস্তান আমলে ৬৯ এ আইয়ুব শাসন আমলে কার্টুন এঁকে নয়মাস জেল
খেটেছেন। জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সান্নিধ্যে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলজীবনের এই স্মৃতি বহুবার, বারবার বলতেন আপনি।
তোফাজ্জল ভাই আপনি একদিন ইসলামি ফাউন্ডেশনে নিজ কার্যালয়ে আপনার জেলজীবনের একখণ্ড স্মৃতি তুলে ধরলেন। একটা টুপি। দাগ টানা কালো শাদা।
তোফা ভাই, কার্টুনটা এঁকেছিলেন অসাধারণ। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুটি ম্যাপ। মাঝখানে একটি গরু। পূর্ব পাকিস্তানে ঘাস খাচ্ছে। আর গরুটা দুধ দিচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। অসাধারণ কার্টুন। এই একটি কার্টুন পাকিস্তানের বৈষম্যকে তুলে ধরে। জেল খাটা গৌরবের বিষয়। তোফা ভাই সেই গৌরব করতেন।
৩
তোফাজ্জল ভাই আপনার কণ্ঠস্বর ছিল মিষ্টি ও দরাজ। শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তি চর্চা করতেন। বাংলাদেশ বেতারে দীর্ঘদিন খবর পড়েছেন। আপনার ছড়া ও কবিতার বই অনেকগুলো। কিছু বই আছে সম্পাদিত। আপনি শৈশব কৈশোরের স্মৃতিকথাও লিখেছেন। খুব করুণ ও অসহায় ছিল আপনার ছেলেবেলা। মাতৃহারা সন্তান। ভাসতে ভাসতে আপনি ঢাকা শহরে আসেন। কত সংগ্রাম। কত ত্যাগ। কত কষ্ট। কিন্তু স্বপ্ন থেকে দূরে সরে যাননি। কোনো তরুণ ভালো লিখলে তার জন্য কিছু করার চেষ্টা করতেন। সে যুগে অনেক তরুণের প্রথম বই প্রকাশে আপনি সহযোগিতা করেছেন। ভালো পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশের সুযোগ করে দিতেন। সবচেয়ে বড় কথা ভালো বই পড়তে আপনি উদ্বুদ্ধ করতেন। সামান্য আয় ছিল আপনার। অনেক টাকা ব্যয় করতেন বই ক্রয়ে। আপনি একদিন বলেছিলেন, আমীরুল তোমার জন্য কিছু বই বাছাই করে রেখেছি। একদিন পাঠিয়ে দেব। তোমার কাছে থাকলে যত্নে থাকবে।
নাহ! তোফাজ্জল ভাই আপনার শরীরিক অবস্থার অবনতির জন্য সেই বই আর আমার হস্তগত হয়নি। এই আফসোস থাকবে চিরকাল।
তোফাজ্জল ভাই, আপনার দুই কন্যা সুপ্রতিষ্ঠিত। ভাবীও ছিলেন আপনার সাথে ছায়ার মতো। জীবনে কোনো দুঃখবোধ ছিল না। খুব সামান্য চাওয়া পাওয়া। তাই সুখী মানুষের প্রতীক ছিলেন আপনি। যা ইচ্ছা হয়েছে তাই করেছেন। নিজের স্বাধীনতাকে খর্ব করেননি। তরুণদের বই পাঠে খুব উৎসাহিত করতেন। কিছু কিছু বিষয় ছিল আপনার খুব প্রিয়। দেশ বিভাগের যন্ত্রণা, ভাসানী, শোষিত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম, ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস, কবিতার ছন্দ, বাংলাভাষা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসতেন। আপনার সঙ্গে অনেক বিষয়ে মতবিরোধ হতো। তাতে আপনি মনঃক্ষুণ্ন হতেন না।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার অনেক প্রশ্ন ছিল। আমরা প্রশ্নহীন মুক্তিযুেদ্ধ আস্থাশীল। বঙ্গবন্ধুর কোনো কোনো কার্যক্রমের প্রতি আপনি একমত হতে পারতেন না। আশি দশকের শুরুতে এসব নিয়ে আমরা ব্যাপক তর্ক করতাম। আপনি তর্কে অংশ নিতেন। কিন্তু উত্তেজিত হতেন না। বরং আমাদের উত্তেজনাকে প্রশমিত করতেন। একসময় অনুশীলন সংঘের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে আসে। আমরা উঠতি তরুণের দল জীবনের বৃহত্তম প্রেক্ষাপটে যে যার মতো ছড়িয়ে পড়লাম। আপনার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ক্ষীণ হলেও আপনার খোঁজ
খবর রাখতাম।
অনেককিছু করা উচিত ছিল আপনার জন্য। আপনি ছিলেন অভিভাবক। আমার চাচা কবি হাবীবুর রহমান এবং পিতা সাইফুর রহমান এর সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল আপনার। তাই আপনি সারাজীবন পিতৃস্থানীয় ছিলেন আমার। আপনার মৃত্যু সংবাদে আমি পিতৃবিয়োগের কষ্ট পেয়েছি। এক বুক হাহাকার নিয়ে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে গেলাম। যেখানেই থাকুন তোফাজ্জল ভাই ভালো থাকবেন।
৪
আমরা আপনার শিষ্য। আমাদের সামান্য কিছু অর্জন তা পেয়েছি আপনার সান্নিধ্যে। লেখক হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেছি আপনার কাছ থেকে। আপনার কাছে আমাদের ঋণের শেষ নাই। আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।