হাদুদ পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী মোহাম্মদ এখন বাড়তি আয়ের উৎস খুঁজতে দিশেহারা। বাচ্চাদের ওপর কড়া নিষেধ জারি করেছেন, অযথা যেনো বাতি জ্বালিয়ে না রাখে। বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ে তার এই সাবধানতা। হ্যাঁ, এটাই ২০১৬ সালের সৌদি আরব!সৌদি অর্থনীতির প্রাণ জ্বালানী তেল। আর সেই তেল এখন বিশ্ববাজারে ব্যারেল প্রতি মাত্র ৩০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। মুমুর্ষূ অর্থনীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে সাধারণ সৌদিদের জীবনে।
বিশ্বমন্দায় এতোদিনে হাদুদ পরিবারের এই নতুন নীতি বেশ আগেই চালু আছে ইউরোপ-আমেরিকার ঘরে ঘরে। সেখানে কৃচ্ছতার নীতি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে একেবারে ঘরগৃহস্থালীতে পাকাপোক্ত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে তেল সাগরে ডুবে থেকে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত সৌদিদের জন্য জ্বালানী তেলের দাম কমার ধাক্কাটা লেগেছে বেশ জোরে।
সৌদির রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোহাম্মদ হাদুদের ভাষ্যে দেশের সংকটের সুর স্পষ্ট। ৩০ বছর বয়সী এই শিক্ষক জানান,‘ অনেক কিছুতে পরিবর্তন আসছে। অধিংকাশ তরুণ এই হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না’।
তেল সামাজ্যের পতনের সুর বইছে সৌদি রাজপরিবার থেকে শুরু করে সাধারণ সৌদি পরিবারগুলোতে। সবচেয়ে হতাশায় আছে দেশটির তরুণ সমাজ। সৌদির মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগই তরুণ। বিদেশী শ্রম নির্ভর দেশটিতে অভ্যন্তরীণ বেকারত্বও প্রকট। এরপরও এতোদিন এই বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে টাকার জন্য ভাবতে হয়নি। ফ্রিতে মিলেছে স্বাস্থ্য সেবা, জ্বালানী তেল পেয়েছে নামমাত্র মূল্যে। তবে এখন সব কিছুতেই অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকার।
তবে এই সংকট সৌদিদের এনে দিচ্ছে বিকল্প চিন্তা, পুরোনো কট্টর ব্যবস্থায় পরিবর্তনের পথও সুগম করছে। শরিয়া আইন নির্ভর দেশটিতে ধর্মীয় অনুশাসন রক্ষায় নিয়োজিত সম্ভ্রান্ত পুলিশ বাহিনীর খরচের লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে। ‘যেভাবে ইচ্ছা খরচ করো’ ব্যাপারটি এখন জবাবদিহির আওতায় আসছে। বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক হই-হুল্লোর প্রবণতা থাকলেও এতোদিন এই পুলিশ বাহিনীই ছিলো অবিবাহিত প্রেমিক যুগলের জন্য যমদূত। ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালোবাসা দিবসে গোলাপ দেখলেই তেড়ে আসা এই পুলিশকে এবার নমনীয় হতেই হচ্ছে, খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে পশ্চিমা নীতির সঙ্গে।
অচল প্রায় অর্থনীতিকে চালাতে ‘নারীরা কেনো চাকরি করবে’ নীতি থেকেও বেরিয়ে আসছে সৌদি। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কয়েক বছর আগের সৌদির সঙ্গে এ পরিবর্তন যেনো রাত-দিনের পার্থক্য।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে সৌদিদের সন্দেহ প্রবণতাও কমতে শুরু করেছে। পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নিতে সামাজিক মাধ্যমে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় এখন সৌদি তরুণরা। রাজপরিবারের চোখ রাঙানিও এক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে। অনেক তরুণ ই-কমার্সে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার রপ্ত করে রোজগারের পথ খুঁজে নিচ্ছে।সৌদি জনপরিসরেও আসছে পরিবর্তন।
আগে সৌদি রেস্টুরেন্টগুলোকে কারাগারের সঙ্গে তুলনা করা হতো। খাবার টেবিলগুলো ঘিরে রাখতো পর্দা, পাছে কেউ পরিবারের মেয়েদের দেখে ফেলে! এমনকি মেয়েরা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে পারবেন এমন নোটিশ ঝুলতো দরজায়। এখন সেখানেই তরুণীরা দলবেঁধে আসছেন, তুলছেন সেলফি।
রেস্টুরেন্টগুলোতে গান বাজছে, টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে কার্টুন ছবি।সব সৌদিই যে পরিবর্তন চান, ব্যাপারটি আবার সেরকমও নয়।
আন্তরিকভাবে পরিবর্তন চান এমন তরুণ যেমন আছে তেমনি কট্টর অনুশাসনপন্থীদেরও অভাব নেই। তরুণীদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা আপাদমস্তক ঢেকে রেস্টুরেন্টে ঢুকেই আদেশ জারি করেন ‘এই ওয়েটার, গান বন্ধ করুন’। কাস্টমার বলে কথা, ওয়েটার আদেশ মানেন। তবে তারা খাবার শেষে বেরিয়ে গেলেই মুক্তির আনন্দে আবার বেজে ওঠে মিশরীয় কোনো প্রেমের গান।