চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

তিস্তা চরের স্বপ্নহীন কন্যাশিশু আর বাল্যবিবাহের গল্প

দেশের উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট জেলার অংশে তিস্তা নদীর বুকে রয়েছে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় সব দ্বীপচর। দ্বীপচরগুলোর নামগুলোও বাহারি এবং বর্ণময়। উল্লেখযোগ্য চরের মধ্যে রয়েছে চর পাটিকাপাড়া, চর হলদিবাড়ি, চর পারুলিয়া, চর আরাজি, চর গোবর্ধন, চর কালিকাপুর, চর খারিয়া, চর ফলিমারি, চর সিন্ধুর্ণা, চর হরিণছড়া, চর তালপট্টি, চর ডাওয়াবাড়ি, চর গুড্ডিবাড়ি। এরকম আরো অসংখ্য চর রয়েছে। এসব চরে এখন ধানের ছড়াছড়ি। বন্যার আগে ছিল গম, ভুট্টো। তবে শীতে চরগুলোতে সবুজের সমারোহ  মেলে। তখন একটু বাতাস উঠলেই ফসলের মাঠে দোলা লাগে। ফসলের মাঠ যেনো মাথা নেড়ে হেসে খেলে দোল খায়। সবুজ ফসলের এই  দোল খাওয়ার দৃশ্য যে কোনো নাগরিক মানুষের হ্নদয়ে অন্যরকম অনুরণন তোলে।

বিস্তীর্ণ চর ভূমির এটি চিরায়ত এক রূপ। কিন্তু এই দৃশ্য বা অপরূপতা চরের কন্যাশিশুদের ‍হৃদয়ে সেভাবে অনুরণন তোলে না, যতোটা নাগরিক হৃদয় উদ্বেলিত হয়। চরের হতদরিদ্র পরিবারের কন্যাশিশুরা কিশোরী বা তরুণী হিসেবে পূর্ণতা পাওয়ার আগেই তাদের সব স্বপ্নের যেনো সমাপ্তি ঘটে। ফসলের মাঠের সেই অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করার আগেই লালশাড়ি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাদের। তারপর অল্প বয়সেই সংসারের এক দায়িত্বশীল নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হয়। এখানেই গল্প শেষ নয়। বিয়ের স্বল্প সময়ের মধ্যেই আবার তাদের মাতৃত্বকে বরণ করে নিতে হয়। জীবনের সুন্দর স্বপ্নগুলো এভাবেই তাদের সংকুচিত হয়ে আসে।

চরের বেশিরভাগ কন্যাশিশুর জীবনের এটিই নিয়তি, এটিই অনিবার্য। বছরের পর বছর বা যুগ যুগ ধরে তিস্তার চরগুলোতে এরকমই এক অর্ন্তগত সংস্কৃতি বিরাজমান। দেশভাগ থেকে শুরু করে আজ অব্দি তিস্তার চরে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে যা ছিল এখনও সেই অবস্থা। সেই পুরনো প্রহেলিকা। এই অবস্থার জন্য অবশ্য তারা একটুও দায়ী নয়। তাদেরকে অসচেতন বা কু-সংস্কারাচ্ছন্ন বলাও অন্যায়। কারণ রাষ্ট্র এবং আলোকিত মানুষের দাবিদাররাও তাদের পাশে খুব একটা দাঁড়ায়নি। উন্নয়ন সংগঠনগুলোর কিছুটা প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। কিন্তু নানা প্রকল্প নিয়ে চরে কার্যক্রম শুরু করলেও ধারাবাহিকতা রক্ষা হয় না। প্রকল্প শেষ তো, সব শেষ। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। 

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য তিস্তা বুকের বেশিরভাগ দ্বীপচরে কিশোরী বা তরুণী মেয়েদের দেখা পাওয়া ভার। সেই তুলনায় চরে কিশোরী বধূর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। তুলনামূলকভাবে দ্বীপচরে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি বলেই এমনটি হয়েছে। সরকার অনুসৃত আইন এখানে কেউ সেভাবে অনুসরণ করে না। মেয়ে একটু বড় হলেই বাবা-মা বিয়ে দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠে। অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা চর সংস্কৃতিরই অংশ। এর পেছনে অবশ্য নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ জড়িত। মনস্তাত্ত্বিক কারণও আছে ঢের। মেয়ে বড় হলে ভালো পাত্র পাওয়া যায় না- এরকম একটি সংস্কার চালু আছে চরবাসীর মাঝে। স্বভাবতই মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে দেওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেন অভিভাবকরা। যৌতুকেরও ঢের প্রচলন রয়েছে। তাও নগদ টাকার লেনদেনই বেশি। চরে মাধ্যমিক স্কুল না থাকার কারণেই অভিভাবকরা কন্যাশিশুকে আগেভাগেই পাত্রস্থ করেন।  

পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী চরে কিশোরী বয়সেই নব্বই ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। গড়পড়তায় দশ থেকে চৌদ্দ-পনেরো বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আঠারো বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া শাস্তিমূলক অপরাধ। কিন্তু চরের বেশিরভাগ অভিভাবকের এ তথ্য জানা নেই। আবার যাদের জানা আছে তারাও বিষয়টি অনুসরণ করেন না, সমাজ ব্যবস্থা এবং অভাব দারিদ্রের কারণেই।    

কথা হয় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার চর ডাওয়াবাড়ির কিশোরী সুখজানের সাথে। সুখজানের বয়স বারো বা তেরো হবে। এই বয়সেই সে একসন্তানের মা হয়েছে। সুখজান অভাবী ঘরের মেয়ে। বছর দুয়েক আগে তার বিয়ে হয়েছে। স্বামী কৃষি শ্রমিক। সুখজানের মতো আরো অনেকেই আছে যাদের অল্প বয়সে বিয়ে করার পর এক বা দু সন্তানের মা হতে হয়েছে। মা হওয়ার পর সংসারে দায়িত্ব বেড়েছে আরো। এখানে উল্লেখ্য, হাতীবান্ধার চরগুলোতে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি। গত বছর এই উপজেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করা হলেও সেভাবে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। 

অল্প বয়সে মা হতে গিয়ে চরের অনেক কিশোরী বধূর মৃত্যুও হয়েছে। চর এলাকাতে স্বাস্থ্যসেবা মারাত্বক রকম অপ্রতুল থাকায় গর্ভবতী মেয়েরা সুচিকিৎসা পান না। গর্ভাবস্থায় অবহেলা আর উপেক্ষার শেষ নেই। আর এ কারণে এখানে মাতৃমৃত্যুর হারও অনেক বেশি। চর ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ অভিভাবক মনে করেন দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা বয়সে বেশি বড় হলে তাদের আর চাহিদা থাকে না। ফলে বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। সামাজিক নিরাপত্তার কারণেও অনেকে দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। 

গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনের কর্মকাণ্ডের ফলে তিস্তা চরের অনেক কিশোরীই এখন বাল্যবিবাহ সমর্থন করে না। নিকটজনদের দুর্গতি দেখে তাদের অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে অনাগ্রহের শেষ নেই। সে কথাই বলছিলেন চর বোয়ালমারির কিশোরী বুলবুলি। এই কিশোরী একটি উন্নয়ন সংগঠন পরিচালিত স্কুলে লেখাপড়া করে। বাল্যবিবাহের কুফল সে বেশ ভালোই জানে। স্কুলের শিক্ষকরাও এবিষয়ে তাকে সতর্ক করেছে। বুলবুলি স্কুলে হাতের কাজ শিখছে। তার ইচ্ছে একটি সেলাই মেশিন কিনে জামা-কাপড় বানানোর কাজ করবে। কিন্তু পরিবারের মানুষগুলোর কাছে তার এই ইচ্ছের তেমন কোনো মূল্য নেই। বুলবুলির তাই সরল স্বাকারোক্তি- বাপে মায়ে বিয়ে দিলে আমারতো আর কিছু করার নেই। আমাকে বিয়ে করতেই হবে। তবে আমার মন চাই না এখনই বিয়ে করতে। আমি অনেক কাজ শিখতে চাই। চাকরি করতে চাই। 

শুধু বুলবুলি নয়, লালমনিরহাটে তিস্তার বুকে চর শোলমারী, চর হলদিবাড়ি, চর পারুলিয়া, চর আরাজি, চর গোবর্ধন, চর কালিকাপুর, চর খারিয়া, চর ফলিমারি, চর হরিণছড়া, চর তালপট্টি, চর ডাওয়াবাড়ি, চর গুড্ডিবাড়িসহ যে অসংখ্য দ্বীপচর রয়েছে সেখানকার কোনো কিশোরীরই ইচ্ছের স্বাধীনতা নেই। তাদের সব ইচ্ছেই যেনো অবরুদ্ধ হয়ে আছে সমাজ আর অর্থনৈতিক অবস্থার ম্যারপাঁচে। কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড অনেকদিন ধরে তিস্তা চরের মানুষের সার্বিক জীবন মানন্নোয়নে কাজ করছে। এই প্রকল্পের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চরের মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ তাদের মৌলিক অধিকারগুলো এবং সরকারি সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত বলেই বাল্যবিবাহ, যৌতুকসহ যে সব অন্তর্গত সংস্কৃতির মাঝে নিমজ্জ্বিত তা থেকে বের হতে পারছে না।  হাতীবন্ধার চরে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন উন্নয়ন সংগঠন এসোডের ম্যানেজার মমতাজ বেগম। দীর্ঘদিন ধরে তিনি চরের মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। তার মতে চরগুলো দুর্গম হওয়ার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কন্যাশিশুদের বড় অংশই আর উচ্চশ্রেণীতে পড়ার সুযোগ পান না। ফলে অভিবাবকরা বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাই জরুরি বলে মনে করেন। তার মতে, শুধু আইন করে এবং সচেতনতা তৈরির কথা বলে তিস্তা অথবা দেশের কোনো দুর্গম চর এলাকায় বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব নয়। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে সরকারের বেধে দেওয়া নিদিষ্ট সময় (১৮ বছর) যারা অনুসরণ করবে সেইসব মেয়েদের জন্যে শিক্ষা, চাকরি, ভাতাসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। রাষ্ট্র কর্তৃক এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হলে অভিভাবকরা সচেতন হওয়ার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ মুখ ফিরিয়ে নিতে উৎসাহিত হবে। 

আসলে শুধু সচেতনতার কথা বলে দেশের সবঅঞ্চলে বাল্যবিবাহ রোধ করা অসম্ভবই। তিস্তাসহ বিভিন্ন দ্বীপচরে বাল্যবিবাহ রোধে সরকারকে অবশ্যই আলাদা করে ভাবতে হবে। নইলে স্বপ্নহীন কিশোরীরা কোনোদিন ডানা মেলে উড়তে পারবে না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)