কথিত প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে পছন্দের মানুষকে কুপিয়ে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা- ভয়াবহ এবং বিকৃত এই অপরাধটির প্রবণতা এ বছর যেন একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। ঘটনা ঘটার পর আইনি ব্যবস্থা নেয়া জরুরি; তবে ঘটনাটি ঘটার আগেই লক্ষণ বুঝে নারীকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিদরা।
কথিত ‘প্রেম’-এর নামে ঘৃণ্য এই অপরাধগুলো ঘটানো ব্যক্তিদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন তারা।
মানসিক সমস্যা বিষয়ক কাউন্সেলর সাহিদা সুলতানা বলেন, এ ধরনের অপরাধ যে আগে ঘটত না তা নয়। কিন্তু এ বছর এর নৃশংসতা আর তীব্রতা যেন একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। তবে ঘটনাগুলো একটি দিনে ঘটলেও এর ভিত্তি তৈরি হয় সংঘটনকারীর মানসিক প্যাটার্নের ওপর নির্ভর করে।
‘যারা ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তাদের মনে বেশিরভাগ সময়ই এই বিষয়টি কাজ করে যে, আমি যদি কাউকে না পাই তাহলে এমন কিছু করবো, যেন সে আর কারও জন্যই পৃথিবীতে না থাকে। আর যদি থাকেও তবে তার জন্য যেন নতুন জীবনের কোনো সুযোগ না থাকে। এই যুক্তিটা তাদের মধ্যে কাজ করে।’
এজন্য ব্যক্তিত্বের বিকাশকালীন পরিস্থিতিকে দায়ী করেন সাহিদা। ওই সময়টায় যে যত্নটুকু প্রয়োজন তা যদি একটি শিশু না পায় তবে তার মানসিক চিন্তাধারা পরিণত হয় না। এভাবে বড় হওয়া একজন মানুষ সঠিক যুক্তিটা ধরে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, ইতিবাচকভাবে ভাবতে পারে না।
‘যেমন আমরা পরিবারে অনেক সময়ই বিভিন্ন কারণে বাচ্চার মতামতের মূল্যায়ন করি না। বরং আমাদের অনেক সিদ্ধান্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দেই। এতে বিষয়টি তাদের মনে জেদ হিসেবে বেড়ে ওঠে। পরবর্তীতে অন্যের মতামতের প্রতি এরা সম্মান দেখাতে পারে না।
পরিবার থেকে এরা সঠিক শিক্ষা পায় না। তাই সব হামলাকারী মানসিকভাবে ‘অসুস্থ’ এটা বলার সুযোগ নেই। তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবেই বৈশিষ্ট্যগুলো গড়ে উঠেছে। এছাড়াও একটির পর একটি ঘটনা আগের ঘটনাটিকে মানুষের মন থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। তাই এভাবে আড়াল হতে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচিত প্রতিটি ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া।’
খারাপ কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যদি মানুষেরা অপরাধীদের আইনের আওতায় শাস্তি পেতে দেখে তাহলে তাদের মধ্যে ভালমন্দের জ্ঞান পোক্ত হবে। নইলে খারাপ কাজ করে তো বেঁচেই যাওয়া যায় – এই চিন্তা মনে গেঁথে গেলে মানুষ অপরাধ করতে আগ্রহী হতে পারে। আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের ওপর মহল থেকে এই অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে দাঁড়িয়ে উদাহরণ তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন এই মনোবিদ।
সাহিদা সুলতানার সঙ্গে একমত হয়ে ‘অ্যাকশন এগেইনস্ট হাংগার’ এনজিও’র উপ-প্রধান ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মিতা রাণী রায় চৌধুরী বলেন, এ ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে হামলা করাটাকে ব্যক্তি অপশন হিসেবে ভেবে নিতে পারে। ভাবতে পারে, প্রেমে ব্যর্থ হলে বা কারও সিদ্ধান্ত মনমতো না হলে তাকে আঘাত করা যেতেই পারে।
সাম্প্রতিক ঘটনা ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনেও এমন ঘটনা দেখে থাকলে সেখান থেকে এরা শিক্ষা নিতে পারে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে কথা না শোনায় মারধর পেলে সেটাও অনেকের মনে গেঁথে যায়। তবে সামাজিক ছাড়াও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেছেন এই সাইকোলজিস্ট। বলেন, কিছু কিছু মানুষের মধ্যে আগ্রাসী হরমোন বেশি থাকে। কারও মধ্যে আবার আকস্মিক আবেগ নিয়ন্ত্রণে জটিলতা দেখা দেয়। তারা আবেগের বশে হঠাৎ করে কিছু একটা করে ফেলা থেকে নিজেকে থামাতে পারে না।
সাম্প্রতিক হামলাগুলোর ক্ষেত্রে ‘লাভ অবসেশন’ বলে একটা বিষয় কাজ করতে পারে বলে মনে করেন মিতা চৌধুরী। এ ধরণের আচ্ছন্নতার বশবর্তী অবস্থায় ভালোবাসার মানুষটিকে পাবার জন্য বা তাকে না পেলে একজন ব্যক্তি যে কোনো কিছু করে ফেলতে পারে, খুনও করতে পারে।
আবার অনেকের মধ্যে দেখা যায়, তারা কোনো কাজ করার আগে ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভাবে না। হঠাৎ করে কিছু একটা ভেবে করে ফেলে। তাদের মধ্যে চিন্তাধারার পরিপক্কতা কম থাকে বলে উল্লেখ করেন মিতা চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীও বলেন, এই অপরাধীরা সম্ভবত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজের পরিণতির কথা ভাবছে না, অথবা মনে করছে এসব করেও তারা বেঁচে যেতে পারবে।
আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারাটা এক ধরণের মানসিক সমস্যা বা অসুস্থতার লক্ষণ বলে মনে করেন এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘যারা মানসিকভাবে সুস্থ, তারা রাগকে শান্তিপূর্ণভাবে প্রশমিত করতে পারে। আবেগের বশে ভাংচুর করা, নিজের বা অন্যের ক্ষতি করা সুস্থতার নির্দেশক নয়।’
হামলাকারীদের মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিলেটের এমসি কলেজে নার্গিসের ওপর হামলাকারী বদরুল এবং উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের কাছে রিশার হত্যাকারী ওবায়দুলের প্রসঙ্গ টেনে কামাল আহমেদ বলেন, ‘এরা প্রকাশ্যে হামলা চালিয়েছে। এদের আচরণের মধ্য দিয়ে একটা বেপরোয়া ভাব প্রকাশ পেয়েছে, আশপাশে কে দেখছে তাতে এদের কিছু আসে যায়নি। এরা ভেবেছে, ওই মুহূর্তে সেই কাজটি করাই তার জন্য সবচেয়ে বড়। অর্থাৎ আমার যা হয় হোক, কিন্তু যে আমাকে এত কষ্ট দিয়েছে তাকে আমি শেষ করব – এমন একটা ধ্বংসাত্মক চিন্তা ছিল তাদের।’
এসব ঘটনায় অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থার মাধ্যমে সবার জন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি জরুরি বলে মনে করেন এই তিন মনোবিদ। পাশপাশি সরকার ও গণমাধ্যমকে ঘটনাগুলোতে বিচারের অগ্রগতি ও শাস্তির ফলোআপ সম্পর্কে দেশের সবখানে ফলোআপ তথ্য ছড়িয়ে সবাইকে জানাতে হবে বলে উল্লেখ করেন কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।
প্রেমে ব্যর্থ হলেই কাউকে আঘাত করা যায় – এই মনোভাবটা যেন কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত না হয়, গণমাধ্যমের প্রতি এই অনুরোধ জানিয়েছেন এই মনোবিদ। কেননা একজন নারীর অবশ্যই স্বেচ্ছায় জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার অধিকার রয়েছে।
এছাড়া শিশুদের ছোটবেলা থেকে সহিংস ঘটনা ও আচরণ থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেন এই তিনজনই। কেননা এসব থেকে শিশুরা ভবিষ্যতে আগ্রাসী আচরণ শিখতে পারে।
তবে এরপরও কথা থেকে যায়। মিতা রাণী রায় বলেন, ‘ঘটনা তো একদিনে ঘটে না। এর আগে থেকেই হামলাকারীর আচরণে পরিস্থিতি কম-বেশি প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে প্রতিরোধ হিসেবে যদি মেয়েটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ উপযুক্ত জায়গাগুলোয় জানিয়ে রাখে তাহলে অনেক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা সম্ভব।’