ভারতের উত্তরাংশের একটি তৃণভূমিতে ঘোড়া চড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন আসিফা বানু (৮)। বেগুনি রংয়ের পোশাক পরেছিলো সে। ঘটনাটি জানুয়ারির শুরুর দিকের। একজন লোক সেসময় তাকে পাশের জঙ্গলের দিকে ইশারা করে। মেয়েটিও তার কাছে যায়।
স্থানীয় পুলিশ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানায়, লোকটি তখন আসিফাকে জোড় করে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দেয়। এক বন্ধুর সহায়তায় মেয়েটিকে পাশের মন্দিরে টেনে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে।
জম্মু কাশ্মীরের পুলিশ আরও জানায়, এরপরের তিনটি দিন, এই দুই লোক ও কমপক্ষে আরও একজন আসিফাকে ধর্ষণ করে বারবার। এই ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা তদন্তকারীদের জানায়, তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আসিফা যে যাযাবর সম্প্রদায়ের অন্তর্গত, সেই বাকারওয়ালদের এলাকা থেকে তাড়ানো। শেষে আসিফাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। তবে হত্যার আগে, আসামীদের একজন শিশুটিকে শেষবারের মতো ধর্ষণের জন্য জোড় করছিলো বলেও জানা যায়।
কয়েকদিন পর আসিফার দেহ পাওয়া যায় জঙ্গলে, সেই একই বেগুনি পোশাকে, কিন্তু পোশাকটি তখন ছিলো রক্তমাখা।
এই ঘটনার সাথে জড়িত অভিযোগে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের অনেকেই দোষ স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে জম্মু কাশ্মীরের পুলিশ।
অভিযুক্তদের মধ্যে দুইজন পুলিশ অফিসারও রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টার অভিযোগ উঠে।
গ্রেপ্তারকৃতদের একজন নিজের বয়স ১৫ বছর দাবি করে। কিন্তু মেডিকেল পরীক্ষার ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে তার বয়স কমপক্ষে ১৯ বছর। ভারতীয় আইনে ধর্ষণ ও হত্যার ক্ষেত্রে ১৬ বছরের বেশি বয়সীকে প্রাপ্তবয়স্ক বিবেচনা করা হয়।
ভারতে যৌন সহিংসতার ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু এই ঘটনায় ভিন্নতা রয়েছে। আসিফার মৃত্যুর পরের মাসগুলোতে, তা ধর্মীয় যুদ্ধের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এই ঘটনার প্রেক্ষীতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে- তারা আসিফার জন্য ন্যায় বিচার চায় না, তারা দাড়িয়েছে অভিযুক্তদের পক্ষে।
গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই হিন্দু এবং আসিফার সম্প্রদায় বাকারওয়ালরা মুসলিম। এই মামলা তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের কয়েকজনও মুসলিম। হিন্দু অ্যাক্টিভিস্টদের দাবি,“এদের বিশ্বাস করা যায় না। ”
চলতি সপ্তাহে, পুলিশ অফিসারদের অভিযোগপত্র জমা দিতে আদালতকক্ষে প্রবেশে বাধা দেয় হিন্দু আইনজীবীদের একটি দল। পরবর্তীতে পেপারওয়ার্ক শেষ করতে অফিসাররা বিচারকের বাসায় যায়।
ঘটনার প্রেক্ষিতে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। বুধবার ভারতের উত্তরাংশের একটি ছোট শহর কাঠুয়াকে অচল করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। শহরটির কাছেই আসিফাকে হত্যা করা হয়েছিলো। বেশ কয়েকজন হিন্দু নারী রাজপথ অবরোধ করে রাখে। অনশন ধর্মঘটও করে।
বিক্ষোভকারীদের একজন বিমলা দেবী দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে জানায়, “তারা আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে।” অভিযুক্তদের মুক্তি দেওয়া না হলে তারা নিজেদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিবেন বলেও জানান।
পুলিশ জানায়, প্রমাণ এবং ডিএনএ পরীক্ষার ফল গ্রেপ্তারকৃতদের সম্পৃক্ততার বিষয়টিই জোড়ালো করে। কমপক্ষে ১৩০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে বলেও জানায় পুলিশ।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অবশ্য রাজ্য পুলিশের হাত থেকে মামলাটি সরিয়ে নিতে চায়। তাদের দাবি সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এই মামলার জন্য অধিক উপযুক্ত। তারা আরও নিরপেক্ষভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারবে।
অনেকেরই আশঙ্কা বিজেপির এই উদ্যোগ অভিযুক্তদের শাস্তি কমানোর প্রচেষ্টা, কারণ সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন, যা নিয়ন্ত্রণ করে বিজেপি।
ঘটনার কেন্দ্রে একটি হিন্দু মন্দির থাকায় তা বিষয়টিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। পুলিশ বলছে, বাকারওয়ালদের ভয় দেখাতে মন্দিরটির তত্ত্বাবধায়ক সাঞ্জি রাম এই পরিকল্পনা করে এবং তার ভাতিজা এবং কয়েকজন বন্ধুকে দিয়ে আসিফাকে অপহরণ ও হত্যা করায়। পুলিশ বলছে, আসিফাকে টার্গেট করার কারণ সে একা ছিলো এবং সহজ লক্ষ্য ছিলো।
বাকারওয়াল যাযাবররা ভারতের উত্তরাংশের সমতল ও পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে বেড়ানো সম্প্রদায়, তাদের সাথে থাকে পশুর পাল। শীতকালে এই পশুদের জন্য হিন্দু কৃষকদের কাছ থেকে তৃণভুমি ভাড়া নেয় তারা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাঠুয়া এলাকার কয়েকজন হিন্দু এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। গ্রামবাসীরা জানায়, সাঞ্জি রাম এই চক্রের হোতা।
বাকারওয়াল নেতা তালিব হুসেইন বলেন, তার (সাঞ্জি রাম) বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। ছোটবেলায় শুনতাম মুসলিম নারীদের কাছে সাঞ্জি রাম ছিলো একটি আতঙ্কের নাম। একে অন্যকে ভয় দেখাতে তারা সাঞ্জি রামের নাম নিতো। বাকারওয়াল নারীদের সাথে অসদাচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি।
আসিফার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিক্ততা আরও বাড়ে। আসিফার বাবা-মা শুরু থেকেই ভয়ঙ্কর কিছুর আঁচ করছিলেন। প্রথমেই তারা পুলিশকে বিষয়টি জানায়। পরে সাঞ্জি রামের সেই ছোট মন্দিরে ছুটে যান। তখন সাঞ্জি রাম জোড় দিয়ে বলছিলো, তিনি মেয়েটিকে দেখেননি। মন্দিরটি তালাবদ্ধ ছিলো। পুলিশ জানায়, সেই মুহূর্তে আসিফাকে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিলো।
আসিফার বাবা মোহাম্মদ ইউসুপ পুজোয়ালা জানান, তার মেয়েকে একটি কারণে হত্যা করা হয়েছে। আর তাহল বাকারওয়ালকে বিতারণ।
“কিন্তু এখানে আমাদের জমি রয়েছে, জীবন রয়েছে। এটা আমাদের বাড়ি।” কান্নার শক্তিও যেনো তখন তার আর নেই্।
তিনি জানান, আসিফা কখনো স্কুলে যায়নি। যদিও তার ভাইয়েরা গিয়েছে। তার (আসিফার) প্রিয় বিষয় ছিলো মাঠে খেলা করা।