ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকজন বিশিষ্টজনের ছবি নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়েছে। জাত্যভিমান, জাতীয়বাদ, মুরুব্বিজ্ঞান, বড়ভাই তর্ক ইত্যাদি কথাও উঠছে। কারণ ছবিগুলোয় প্রণব মুখার্জি চেয়ারে উপবিষ্ট এবং বাকিরা পেছনে দাঁড়িয়ে। সেই দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ দেশের রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনরা।
তবে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ছবিগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয় এবং একদল অতি জাতীয়তাবাদী এবং বুঝে না বুঝে ভারত বিরোধিতাকারী যেসব মন্তব্য করেছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখা।
সবগুলো ছবির ধরন একই। অর্থাৎ প্রণব মুখার্জি চেয়ারে বসে আছেন এবং বাকিরা পেছনে দাঁড়িয়ে। মানে হলো, পুরোটাই একটি আনুষ্ঠানিকতা। মি. মুখার্জি বয়স্ক মানুষ। দ্বিতীয়ত তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি। তৃতীয়ত তিনি বাংলাদেশের জামাই (নড়াইলে তার শ্বশুরালয়)। সুতরাং তার সাথে ছবি তোলার আগ্রহ অনেকেরই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু পুরো প্রক্রিয়াটি আনুষ্ঠানিক, তাই তিনি চেয়ারে বসেছিলেন এবং ধাপে ধাপে নানা শ্রেণিপেশার বিশিষ্টজনরা তার পেছনে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়েছেন। এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কী ক্ষতি হলো এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মান সম্মানের কীভাবে বারোটা বাজলো, তা বোধগম্য নয়।
অতিবিপ্লবী কেউ কেউ লিখেছেন, এরশাদ যখন বাংলাদেশর রাষ্ট্রপতি, তখন প্রণব মুখার্জি ভারতের একজন সাধারণ মানের মন্ত্রী। সুতরাং এরশাদ কেন চেয়ারে উপবিষ্ট প্রণব মুখার্জির পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবেন? প্রশ্ন হলো, কেউ কি এরশাদ সাহেবকে জোর করে ওখানে নিয়ে প্রণব বাবুর পেছনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলতে বাধ্য করেছেন? এরশাদ নিজে বা আমাদের আরেক বয়ঃজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত অথবা অন্য যারা ছবি তুলেছেন, তারা যদি প্রণব মুখার্জির পেছনে দাঁড়িয়ে অর্থাৎ তাঁকে সম্মান জানিয়ে এভাবে ছবি তুলতে আপত্তি না করেন, তাতে ‘ফেসবুকবিপ্লবীদের’ কী সমস্যা বুঝি না।
বলাই বাহুল্য যে, সমালোচনাটা এসেছে যিনি বসে আছেন তিনি একজন ভারতীয় বলে। তিনি যদি সাবেক বা বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতেন, তিনি যদি সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি অথবা পোপ ফ্রান্সিস (সম্প্রতি তারা বাংলাদেশে এসেছিলেন) হতেন, সম্ভবত তখন এই চেয়ারে উপবিষ্ট এবং দণ্ডায়মান তর্কের সূত্রপাত হত না। অর্থাৎ এই তর্কের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশে দশকের পর দশক ধরে চলমান ভারত বিরোধিতা।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে ভারত কতটা ফ্যাক্টর, দুদেশের সীমান্তসম্পর্ক কতটা তিক্ত, সেভেন সিস্টার্সের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারত কীভাবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়, করিডোর ও বাণিজ্য নিয়ে তারা কী ধরনের অসম আচরণ করে, অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে তারা কী আচরণ করে–এসব নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনার অন্ত নেই। কিন্তু সেই বিতর্কের অংশ হিসেবে প্রণব মুখার্জির মতো একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, যিনি এই মুহূর্তে কেবল ভারতের নয়, পুরো এশিয়ার একজন সম্মানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, তিনি ছবি তোলার আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে চেয়ারে বসে আছেন এবং তার পেছনে অন্যরা দাঁড়িয়ে আছেন বলে তার তীর্যক মন্তব্য করে চিরায়ত ভারত বিরোধিতাকে উসকে দিয়ে সমালোচনার পিচকারিতে ফেসবুকের দেয়াল নোংরা করে দেয়া কোন রুচিবোধের পরিচায়ক নয়। এই ঘটনায় বরং বাঙালির চিরায়ত অতিথিপরায়ণতার যে খ্যাতি ও সুনাম রয়েছে, সেটিই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ভারতের যেসব নাগরিক প্রণব মুখার্জির সঙ্গে এই ছবিগুলো নিয়ে বিবিধ সমালোচনা আর অনভিপ্রেত কথাবার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই আমাদের সম্পর্কে কোন ভালো মন্তব্য করেননি।
ধরা যাক, এ মুহূর্তে আমাদের দেশের অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ভারত সফরে গেলেন এবং তিনিও প্রণব মুখার্জির মতো এরকম চেয়ারে বসে ছবি তুললেন, যার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলেন সে দেশের প্রবীণ ও খ্যাতিমান রাজনীতিবিদরা, তখন ভারতীয়রা যদি এ নিয়ে ছিঃ ছিঃ রব তোলে, সেটা কেমন দেখাবে?
পুরোটাই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। আপনি গ্লাসের অর্ধেক পূর্ণ দেখবেন নাকি খালি, ছুরি দিয়ে আপনি আপেল কাটবেন নাকি মানুষের গলা, সেটি আপনার রুচিবোধ, আপনার শিক্ষা, আপনার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। সুতরাং চেয়ারে উপবিষ্ট প্রণব মুখার্জির পেছনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্টজনদের ছবি তোলার ঘটনা নিয়ে যারা অরুচিকর নানা মন্তব্য করেছেন, তাতে ব্যক্তি হিসেবে প্রণব মুখার্জির কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং ছোট হয়েছেন সমালোচনাকারীরাই। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, এর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও খুব উজ্জ্বল হয়নি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)