চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তিনি জননী, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৮৯তম জন্মবাষির্কী

তিনি জননী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের। তার নাম জাহানারা ইমাম হলেও সেই নামকে ছাপিয়ে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন শহীদ জননী হিসেবে। একাধারে তিনি কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রীও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত নিরলস লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি।

তার লেখা সেই বিখ্যাত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নিজের বড় ছেলে শফি ইমাম রুমী বীরত্বের কথা। বেশ কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে নির্মম নির্যাতনে শহীদ হন রুমী।

স্বাধীনতা অর্জনের পর রুমীর বন্ধুরা জাহানারা ইমামকে সব মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। সেই থেকে তিনি শহীদ জননী। মৃত্যুর পরও অমর তিনি। তরুণ প্রজন্মের মনেও আজও শ্রদ্ধা অার ভালোবাসায় সমুজ্জ্বল তার স্মৃতি।

৩ মে শহীদ জননীর জন্মদিন। ১৯২৯ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৮৯তম জন্মবাষির্কীতে তাকে স্মরণ করে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, তিনি এখনো অমর তার লেখালেখির জন্য। তার কাজই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতগুলো বছর। ৪০ বছর পরে হলেও, এতদিনে এসে যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন হওয়ার সেই আন্দোলনটা চালিয়ে নিয়ে গেছেন তিনিই। এর আগে বঙ্গবন্ধু সেই বিচারটা শুরু করেছিলেন কিন্তু তার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সেটাও শেষ হয়ে যায়।

শাহরিয়ার কবির যোগ করেন, তার দাবি ছিলো মৌলবাদী সম্প্রদায়ের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। তবে যতদিন সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ না হবে ততদিন তার আরো বেশি প্রয়োজন থাকবে। বর্তমানে যারা তরুণ প্রজন্ম তারা শহীদ জননীকে চোখে দেখেনি। কিন্তু গণজাগরণ আন্দোলনের সময়ে আমরা দেখেছি তরুণরা স্লোগান দিয়েছে, আমরা জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সন্তান। তাই তার শুরু করে যাওয়া আন্দোলন থাকবে অনন্তকাল। যতদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গঠিত না হবে ততদিন তার প্রাসঙ্গিকতা থাকবে।

শাহরিয়ার কবির

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলনের ফসল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ করছেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কোনো ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন একজন ব্যক্তিত্ব, একটি প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি নিরলস লড়াই চালিয়ে গেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিশাল আঁধার হয়ে থাকবেন তিনি।

‘যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবির লড়াইটিকে তিনি একটি বাস্তব রূপ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবাসনের পরে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু পট পরিবর্তনের পরে সেই জায়গা পুরোপুরি নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। সেই সময়ে আন্দোলনটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা করেছেন জাহানারা ইমামই।’

তুরিন আফরোজ

প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাকে স্মরণ করবে উল্লেখ করে তুরিন আফরোজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হবার নয়, যুদ্ধাপরাধীর বিচার কখনো শেষ হওয়ার নয়। নুরেমবার্গ ট্রায়াল কত কত বছর আগে হয়েছে। কিন্তু এখনো সেটি একটি নিদর্শন হয়ে আছে। ঘটনাটা শেষ হয়ে যায় কিন্তু তার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবটা থেকেই যায়। তাই সত্য ও মিথ্যার লড়াই যতদিন থাকবে তার আন্দোলন ততদিন শেষ হয়ে যাবে না।

গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী মারুফ রসূল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাদের তাছে জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলি বইটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শলিপি। সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছে অনেকে। তাছাড়া একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গড়ে তোলার পরে রাস্তায় রাস্তায় যেসব কার্টুন ও পোস্টারে ছেয়ে গেছিলো সেগুলো চিনতে শিখিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদের। তখনকার প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বোধ তৈরি করতে তার বই ও আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

‘একাত্তরের দিনগুলি’ বই বিষয়ে তিনি বলেন, এই বইটিতে একটি পরিবারের লড়াই উঠে এসেছে। রুমী তখন শুধু বইতে সীমাবদ্ধ নয় যেন সবার ঘরের সন্তান। সেখানে মা ও সন্তানের লড়াই, দুজনের রসায়ন, মায়ের শাসন এবং সবশেষে দেশপ্রেমের প্রশ্নে মায়ের ত্যাগ সবই সবার মনে প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে। সেটাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতগুলো বছর।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে তার আন্দোলন যেখানে শেষ হয়েছিল; ২০১৩ সালের শাহবাগের আন্দোলন সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল উল্লেখ করে এই ব্লগার ও লেখক বলেন, তার আন্দোলনের ভিত্তিতেই দেশের রাজনীতির পট পরিবর্তন হলো কিন্তু সেটা অব্যাহত থাকলো কোথায়। পরে যুদ্ধাপরাধীই মন্ত্রী হলেন। রাজাকারের গাড়িতে দেশের পতাকা উড়ে। তখন মনে হলো তাহলে তার আন্দোলনের সফলতা কোথায়। তিনি সবসময় আমাদের মাঝে থাকবেন তার দর্শনের জন্য। তিনি বলেছেন, জনগণের বিচারই সর্বোচ্চ বিচার।

৮৯তম জন্মবার্ষিকীর আয়োজন
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৩ মে বিকেল ৪টায় রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষে (দোতলায়) এক আলোচনা সভা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

সেখানে প্রদর্শিত হবে বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র। এছাড়াও ৩ মে ২০১৮ সকাল ৮টায় মিরপুরে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে।

সাড়া জাগানো সেই আন্দোলন
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির মূলহোতা গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করে। সেদিন থেকেই শুরু হয় জনবিক্ষোভের। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়।

জাহানারা ইমামকে করা হয় এর আহ্বায়ক। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়।

এই কমিটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ’গণআদালত’ এর মাধ্যমে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালাতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়।

১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধকেই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য উল্লেখ করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

তবে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের সঙ্গে যুক্ত ২৪ জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে।