আফগানিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে মেয়েদের হাইস্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে তালেবান সরকার। কিন্তু কিছু কিছু এলাকায় নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অভাবনীয় একটি কাজ শুরু করেছে। পাড়ায়-মহল্লায় নারী শিক্ষক পরিচালিত ছোট ছোট স্কুল পরিচালনা করা হচ্ছে। বাসাবাড়ীর পেছনের গোপন পথ দিয়ে এসব স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই প্রচেষ্টাকে তারা দেখছেন নারীদের প্রতি তালেবান সরকারের অবজ্ঞার কড়া জবাব হিসেবে।
গোপন স্কুলের এক নারী শিক্ষক এ গোপন শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে বলেছেন, আমরা এই কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে জানি যেকোন ঝুঁকির চেয়ে নারী শিক্ষা বেশী জরুরি।
তিনি আরো বলেন, মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে গোপনে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমাকে যদি আটক বা নির্যাতন করে তার পরও ধরে নিব আমরা সফল হয়েছি।
গত মার্চ মাসে মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু স্কুলের প্রথম দিনেই তারা জেনেছে, তালেবান সরকার নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে। স্কুল আবারও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গোপন স্কুলের মেয়েদের জন্য প্রকৃত স্কুলে যেতে না পারার কষ্টটা অনেক গভীর। গোপন স্কুলের এক শিক্ষার্থী জানিয়েছে, স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দুমাস পার হয়ে গেছে। এখনও স্কুল খোলার কোন ঘোষণা আসছে না। ভাবলেই খুব খারাপ লাগে।
একথা বলতে বলতে মেয়েটি কান্না চাপতে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে। তবে এসব ভাবনা পেছনে ফেলে ১৫ বছরের এক ছাত্রী গোপনে অন্য মেয়েদের মেসেজ পাঠায়। উৎসাহ দিয়ে বলে, “সাহসী হও। যদি সাহস দেখাও তাহলে কেও তোমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।”
তালেবান সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হওয়ায় স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলো কবে খুলে দেয়া হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে না।
তালেবান সরকার বলছে, প্রথমে ইসলামিক পরিবেশ তৈরী করতে হবে। ছেলে ও মেয়েদের স্কুল দেশটিতে আগে থেকেই আলাদা ছিল। ইসলামিক পরিবেশ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সে সম্পর্কে কেউ ই নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছে না।
তালেবান কর্মকর্তারা বারবার জনসম্মুখে স্বীকার করেছেন, মেয়েদের স্কুল খুলে দেয়া দরকার। পাশাপাশি এ কথাও বলেছেন, মেয়েদের স্কুল শিক্ষা স্পর্শকাতর বিষয়। ১৯৯০ এর দশকে তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন নিরাপত্তা সঙ্কটের কথা বলে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছিল।
এখন বিভিন্ন সূত্র থেকে বিবিসি’কে জানিয়েছে, কট্টরপন্থী কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এখনও স্কুল খোলার বিপক্ষে। আবার সরকারের মধ্যে কিছু সদস্য স্কুল না খোলার সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন। স্কুল সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেয়ায় তালেবান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় খুবই হতবাক হয়েছে। সরকারের উচ্চ পদস্থ অনেকেই কোন উপায় না দেখে তাদের মেয়েকে পাকিস্তান বা কাতারে পড়তে পাঠিয়েছেন।
সম্প্রতি গত কয়েক সপ্তাহে তালেবান সংশ্লিষ্ট কিছু ইসলামী ‘বুদ্ধিজীবী’ ফতোয়া দিয়েছেন যে ধর্মে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আফগানিস্তানের ধর্মীয় নেতা শেখ রহিমুল্লাহ হাক্কানি স্কুল খোলার বিষয়টি নিয়ে গত মাসের সরকারের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। স্কুল বন্ধ রাখার বিষয়টি সরাসরি বিরোধিতা করে করলেও বিবিসিকে বলেছেন, “ধর্মীয় বইপত্রে নারীশিক্ষার অনুমতির কথা বলা হয়েছে। এমনি নারী শিক্ষার বাধ্যবাধকতার কথাও বলা হয়েছে। শরিয়া আইনে কোথাও বলা হয়নি যে নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ। কোথাও এর প্রমাণ নেই।”
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন, কোন নারী অসুস্থ হয়েছেন। এখন আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো শরিয়ত সম্মত পরিবেশে ওই নারীর চিকিৎসার জন্য নারী চিকিৎসক প্রয়োজন।
এরকম একই ধরণের ফতোয়া দিয়েছেন হেরাত এবয় পাকতিয়া প্রদেশের ধর্মীয় নেতারা। এসব ফতোয়া প্রমাণ করে আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার পক্ষে জনমত কত জোরালো। রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতারাও নারী শিক্ষার পক্ষে কথা বলছেন। কিন্তু তালেবান সরকারের উপর এসব কতটা প্রভাব ফেলছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
স্কুল খোলার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তালেবান সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু তালেবান সরকার সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সোর্স জানিয়েছে, সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরাও স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকারীরা কান্দাহারের তালেবান নেতাদের অনুসারী। এ অঞ্চলের তালেবান নেতা মোল্লা হাইবাতুল্লাহ।
গত আগস্টে ক্ষমতা গ্রহণের সময় তালেবান সরকার অনেক নমনীয় আচরণ করলেও সাম্প্রতিক সময়ে তারা কঠোর অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। যেমন খুব সাম্প্রতিক সময়ে ঘরের বাইরে গেলে মেয়েদের বোরকা পরা বা মুখ আবৃত করে পোশাক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাছাড়া ঘরের বাইরে না যেয়ে মেয়েদের ঘরে থাকতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি এক তালেবান নেতা স্কুল খোলার বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে টুইট করেছেন। সামাজিক মাধ্যমে ওই তালেবান নেতার প্রচুর ফলোয়া। ওই পোস্ট দেখার পর আফগানিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনী সেই তালেবান নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের পর ওই তালেবান নেতা তার পোস্ট ডিলিট করে দেন। এবং পোস্টের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
লক্ষ্য করে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে নারী শিক্ষার বিপক্ষে অবস্থানকারী মানুষের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু কিছু তালেবান নেতা উদ্বেগ দেখিয়ে বলছেন, স্কুল খোলা রাখলে ইসলামিক স্টেট (আইএস) গ্রুপ সহজে তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবে।
পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলছে, বিশ্ব দরবারে গ্রহণযোগ্যতা পেতে নারী অধিকার নিশ্চিতের বিষয়টি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পেলে বিদেশে আটকে পড়া কোটি কোটি ডলারও উদ্ধার করতে পারবে না আফগান সরকার।
তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানে সরকার গঠনের পর থেকে সেদেশের নারীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশটির নারী অধিকার কর্মীরা এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন যেন তারা একেবারে অসহায় হয়ে না পড়ে।
গোপন স্কুল পরিদর্শন করে বিবিসি দেখেছে, সেখানে দিনে এক থেকে দুই ঘণ্টা ক্লাস নেয়া হয়। গণিত, জীববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়নের উপর ক্লাসে বেশী জোর দেয়া হয়। দায়িত্বরত শিক্ষকরা জানেন আরো অনেক অনেক মেয়ে স্কুলে আসতে চায়। কিন্তু জায়গার অভাবে তাদেরকে গোপন স্কুলের শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। খুব তাড়াতাড়ি স্কুল খুলে দেয়া হবে বলে ওই শিক্ষক আশা করেন না। তবে তিনি মনে করেন, “শিক্ষিত নারী হিসেবে মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব। কারণ একমাত্র শিক্ষাই আমাদেরকে অন্ধকার থেকে রক্ষা করতে পারে।