সমৃদ্ধ আফগানিস্তান ও আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া আফগানিস্তান এখন কল্পনাই করা যায় না। দেশটির কয়েক প্রজন্ম জানেই না স্বাভাবিক জীবন বলতে কি বুঝায়! তবে দেশটির অবস্থা সব সময় এমন ছিল না। একসময় আফগানিস্তান শান্তির জন্য পরিচিত ছিল।
১৯৭৩ সালের আগ পর্যন্ত রাজা জহির শাহ দেশটি পরিচালনা করছিলেন আধুনিক গণতন্ত্রের আদলে। সেসময় সেখানে বহুতল ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, স্বচ্ছ নির্বাচন ছিল, নারীদের অধিকার ছিল, অন্যান্য দেশের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট শক্ত।
কিন্তু ১৯৭৩ এর শেষ দিক থেকে এই প্রস্ফুটিত রাষ্ট্র’টির সমস্যা শুরু হয়। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা বাড়তে থাকে, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট হতে থাকে। জহির শাহ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
পরের ছয় বছরে অনেক নতুন রাষ্ট্র আসছে-গেছে কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে আফগানিস্তানে কোন স্থিতি অবস্থা বিরাজ করেনি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের জন্য। আর এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে বিদেশি শক্তি গুলো আফগানিস্তানের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। ১৯৭৯ সালের দিকে তখনকার পড়াশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাবতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আফগানিস্তান রাষ্ট্রকে ব্যবহার করবে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানার জন্য।
যেহেতু আফগানিস্তানের সাথে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নভূক্ত “স্তান” রাষ্ট্রগুলোর সীমান্ত ছিলো, তাই সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’ সোভিয়েত সরকারকে জানায়-সোভিয়েত ইউনিয়নের উচিত হবে না আফগানিস্তান হাত ছাড়া করা। আর এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তান অপারেশন শুরু করে।
প্রবল পরাক্রমশালী তৎকালীন সোভিয়েত বাহিনীর কাছে পরমাণু বোমা থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক সব রকম সমরাস্ত্র ছিলো। তাই ধারনা করা হচ্ছিলো খুব সহজেই সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলবে। বেশীরভাগ আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন অনুসন্ধানে জানা যায়, তারা ধারনা করেছিলো সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান দখল করে নেবে খুব সহজেই।
কয়েক মাসের মাঝে এটা সত্যও প্রমাণিত হচ্ছিলো এই অর্থে, প্রায় পুরো আফগানিস্তানেই সোভিয়েত সেনাবাহিনী নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু আফগানিস্তানের একদম ভেতরে প্রবেশ করা আসলে কখনোই সহজ ছিল না এবং এর চাইতেও দুরূহ কাজ ছিল নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা।
শত বছরের আফগান ইতিহাস থেকেই দেখা গেছে তারা উপনেবেশিক শক্তিগুলোর বিরদ্ধে প্রতিরোধ করে তুলেছিলো। গ্রীক আর্মি আলেকজেন্দার দ্যা গ্রেট থেকে শুরু করে, চেঙ্গিস খানের মঙ্গল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে আফগানরা অনেক আগে থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো।
আফগানিস্তানের মানুষদের চারিত্রিক বিশিষ্টের মাঝে এমন একটা ব্যাপার আছে যেখানে তাদের কন্ট্রোল করা কিংবা কোন আদেশ পালনে বাধ্য করার ব্যাপারটি তারা সহজ ভাবে কোন দিন মেনে নেয়নি। আর এই কারণেই বিভন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইতিহাস ও সংস্কৃতি আগে থেকেই ছিল। এই জন্য সোভিয়েত রেড আর্মি দেশটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে হিমশিম খাচ্ছিলো ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিরধের মুখে! যাদের বলা হতো আফগান মুজাহিদিন।
সোভিয়েত দখলদারিত্ব ও আমেরিকার অনুপ্রবেশ!
যেহেতু সময়টা ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে চলা “কোল্ড ওয়ার টাইম” তাই আমেরিকা যখন দেখলো আফগানিস্তানের কিছু ছোট ছোট গ্রুপ বা মুজাহিদিনরা সোভিয়েত আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে; তখন আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাদের মত পরিবর্তন করে আফগান মুজাহিদদের সাধুবাদ জানায় নিজেদের গোপন রিপোর্টে।
ওই রিপোর্টে তারা এও জানায় আমেরিকা যদি মুজাহিদিনদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে তাহলে এই আফগানরা রাশিয়ার সাথে হয়তো আজীবন যুদ্ধ করে যাবে।
আমেরিকা মূলত চাইছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল করতে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা বুঝতে পারে, আফগানরা ভয়ে ছিলো তাদের ইসলামিক প্যাশন হয়তো আর থাকবে না, সোভিয়েতরা যদি আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রনে নেয়। এটা বুঝতে পেরেছিলো, আমেরিকা ধর্মের এই বিষয়টিকে পুঁজি করে আরো উস্কে দিতে চেয়েছে, যাতে আফগান মুজাহিদিনরা সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করে যায়।
আমেরিকা এর পর সিদ্ধান্ত নেয় তারা গোপনে যতটা সম্ভব আফগান মুজাহিদের সাহায্য করে যাবে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্বল করার বিষয়টি আমেরিকা মূলত চেয়েছিল অনেকটা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সাথে যা হয়েছিলো সেটার জন্য।
ভিয়েতনামে, দক্ষিণ ভিয়েতনামিজদের সাহায্য করেছিলো মস্কো আর এতে আমেরিকার অনেক সৈন্য মারা যায়, অনেক সামরিক ক্ষতিও হয়েছিলো। তাই আমেরিকা চাচ্ছিলো আফগান মুজাহিদদের মাধ্যমে এর একটা প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু তাদের এটা করতে হয়েছে লুকিয়ে।
আমেরিকার একার পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না। যেহেতু তারা আফগান যুদ্ধ’টাকে ধর্মীয় যুদ্ধের একটা প্রোপাগান্ডা দাঁড় করতে সক্ষম হয়েছিলো কিংবা আফগানদের ভাষায় “পবিত্র জিহাদ”; তাই মধ্য প্রাচ্যের যেই দেশ গুলো আফগানিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল তারা এগিয়ে আসে অর্থ নিয়ে; পাকিস্তান এগিয়ে আসে ওই অর্থ এবং সামরিক সরঞ্জাম আফগান মুজাহিদদের হাতে তুলে দিতে। এই সব বিষয়গুলোর তত্ত্বাবধানে ছিল আমেরিকা। তবে পুরো কাজটিই তারা করেছে গোপনে। অনেক পরে জানা গেছে তারা এই সব করেছে!
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই মূলত এই কাজের দায়িত্ব পায়। তারা আমেরিকান অর্থ ও অত্যাধুনিক অস্ত্র আফগান মুজাহিদদের হাতে তুলে দেয় মূলত খাইবাস পাস হয়ে যেই সীমান্ত আছে সেই জায়গা দিয়ে। আমেরিকার অর্থের সাথে পরবর্তীতে যোগ হয় সৌদি আরবের অর্থ। এদের অর্থ ও সামরিক সাহায্য পেয়ে দেখা যায় আফগান যোদ্ধারা সোভিয়েত আর্মিরকে ঘাবড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো।
তালেবান ও ওসামা বিন লাদের আবির্ভাব
শীতল যুদ্ধের সময়টায়, সোভিয়েত আর্মি সেখানে শুরু করে কমিউনিজম চালুর চেষ্টা! কিন্তু আফগান মুজাহিদিনরা আমেরিকার সাহায্যে সেখানে সোভিয়েত আর্মির বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করে। এতে সোভিয়েত আর্মি বাধ্য হয় বিমান হামলা চালাতে। এদিকে আফানরাও আরো শক্তিশালী হতে থাকে এই অর্থে যে পুরো পৃথিবীতে তখন এই আফগানযুদ্ধকে “জিহাদ” হিসেবে প্রচার করা হয় পশ্চিমা গণমাধ্যম গুলোর সাহায্যে।
আর এতে করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলামিক স্বেচ্ছাসেবীরা আফগানদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তানে ঢুকতে শুরু করে। আর এই স্বেচ্ছাসেবীদের একজন ছিলেন সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন। তরুন ওসামা আফগানিস্তানে শুধু অর্থই না সাথে নতুন নতুন উদ্ভাবনও নিয়ে আসে, যেমন পাহারে সুড়ঙ্গ তৈরি করার যন্ত্র, কিংবা দ্রুত দেয়াল তৈরি কিভাবে করতে হয় ইত্যাদি। আফগান মুজাহিদদের কাছে ওই সময়ে ওসামা ছিল খুবই প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব!
আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে সব তথ্যই জানত ওই সময়ে। যেহেতু ওসামা তখন আফগান মুজাহিদদের সাহায্য করছিলো, রাশিয়ানদের হত্যা করছিলো; তাই ওসামাকে নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। বরং তাকে স্বাগত জানিয়েছিলো আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা। ওই সময় যুদ্ধের কারণে তিন ভাগের এক ভাগ মানুষকে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তে অনেক ইসলামিক স্কুল চালু করা হয়েছিলো আরব এবং আমেরিকান অর্থের সাহায্যে। এখানে ফ্রি পড়াশুনা করা যেত। এই সব মাদ্রাসা স্কুলে যারা পড়তো তাদের বলা হতো “তালেব” অথবা “তালেবান”! তাদের শিক্ষক ছিল স্থানীয় মোল্লারা, যেমন: মহাম্মদ ওমর! যে কিনা পরবর্তীতে তালেবান নেতা হয়! এই সময়টায় এখানকার ছাত্রদের ট্রেনিং দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠানো হতো।
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- “তালেবানরা ওই সময়ে হিরো ছিলো। মাদ্রাসা-স্কুলগুলোতে ছাত্র শিক্ষকদের ওই সময়ে অস্ত্র দেয়া হতো এবং ট্রেনিং দেয়া হতো আমেরিকা ও পাকিস্তানের সহায়তায়। এরপর সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো হতো”।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিজমের পতন
আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের এতো সাহায্যের পরও ১৯৮৬ সাল নাগাদ সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে আরো এগুতে থাকে বিমান হামালা ও স্থলে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে। মুজাহিদদের এয়ার ডিফেন্সের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। এরপর আমেরিকা “স্টিংগার” নামক অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল তুলে দেয় আফগান মুজাহিদদের হাতে।
এ মিজাইল তখনকার সময়ে সব চাইতে অত্যাধুনিক ছিল। এই মিসাইল’ই মুলত আফগান যুদ্ধে টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এরফলে সোভিয়েত বিমানগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো। এই সময়টাই মূলত বুঝা যাচ্ছিলো, হয়তো এই যুদ্ধে আফগানরা জিতেও যেতে পারে।
সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মিখায়েল গরভাচেভ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় তাদের অনেক রক্ত ঝরেছে! ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে আসে। প্রায় ১০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে আমেরিকা, সৌদি ও পাকিস্তানের বিলিয়ন, বিলিয়ন ডলার সাহায্যে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত আফগান মুজাহিদদের জয় হয়।
সাধারণ আফগান নাগরিকরা সেই সময় খুব আনন্দিত ছিল, তারা তখন স্বাধীন! ওসামা বিন লাদেন নিজের দেশে ফিরে যায় ইসলামিক হিরো হিসেবে। ওই সময় বলা হচ্ছিলো ইসলামের বিজয় হয়েছে “গডলেস সোভিয়েতদের” বিরুদ্ধে।
এই যুদ্ধে যে ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি সোভিয়েত ইউনিয়ন আর কোন দিন কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর পরেই মাত্র দেড় বছরের মাথায় সমাজতন্ত্রের পতন হয় রাশিয়া এবং প্রায় পুরো পৃথিবীতে। বলা হয়ে থাকে আফগান যুদ্ধের সুফল পেয়েছিলো পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের দেশ গুলো।
কিন্তু দেখা গেলো আফগান যুদ্ধ অন্যদের সুফল বয়ে আনলেও আফগানদের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন হলো না। অনেকেই বাড়ি ঘরহীন থেকে গেলো। মৌলিক চাহিদাগুলো থেকে বঞ্চিত থেকে গেলো। মূলত সোভিয়েত যুদ্ধ ছিল আরেকটা যুদ্ধের শুরু!
আলকায়েদা ও তালেবানি রাষ্ট্রের উত্থান
মুজাহিদরা সোভিয়েত যুদ্ধের সময় ঐক্যবদ্ধ থাকলেও রেড আর্মি চলে যাওয়ার পর দেখা গেলো এরা প্রতিটা প্রদেশে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করা শুরু করলো। এই সময়ে মুজাহিদ নেতারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে প্রদেশ শাসন করা শুরু করলো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে! আর এই সময়ে মোল্লা ওমরের উত্থান ঘটে সাথে তালেবানের উত্থানও শুরু! কান্দাহারের সাধারণ একজন মোল্লা উমর ঘোষণা করল, সে একটা খাঁটি ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
যেহেতু তখন আফগানিস্তানে গৃহ যুদ্ধ চলছিলো, এই সুযোগে মোল্লা ওমর আস্তে আস্তে গৃহ যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে বিপুল সংখ্যক অনুসারী তৈরি করে। ১৯৯৪ সালের মাঝেই মোল্লা ওমর ও তার অনুসারীরা আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণে নেয় অন্য কোন গোষ্ঠীর কাছে থেকে কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই।
সেখানে তার ভাষায় ইসলামী সরিয়া আইন চালু করে। তাই সাধারণ মানুষও চাইছিলো গৃহ যুদ্ধের অবসান হোক। দেখা গেলো সাধারণ মানুষের সহায়তায়ই অনেকটা তালেবানরা একের পর এক প্রদেশ দখল করতে থাকে। তালেবানরা ঘোষণা করলো তারা আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনবে।
তখন ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে আবার ফিরে আসে। বিন লাদেন ও মোল্লা ওমর নিজেদের মাঝে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। ধারনা করা হয় অর্থের মাধ্যমেই ওসামা বিন লাদেন তালেবানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলো। এই সবই ঘটছিলো আমেরিকা ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সব রকম সাহায্য সহযোগিতায়।
তালেবানরা কাবুল দখল করার পর বুঝা গেলো আফগানিস্তানকে আরেকটি ভয়ংকর সময়ের মাঝ দিয়ে যেতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মাঝেই রেডিও কাবুলের নাম পরিবর্তন করে রেডিও সরিয়া রাখা হলো। সব রকম টেলিভিশন, খেলাধুলা, গান, বাজনা, স্যাটেলাইট টেলিভিশন নিষিদ্ধ করা হয়। কেউ এর ব্যতিক্রম করলে শাস্তি দেয়া হতো নির্দয় ভাবে।
নারীদের অধিকার খর্ব করা হয়, বাড়ির বাইরে কাজ করা বন্ধ করা, বোরখা পরে বাহিরে যেতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন নিয়ম চালু করা হয়। এভাবে আফগান ভবিষ্যৎ আবার আঁধারে হারিয়ে যেতে থাকে।
বিন লাদেন এই সময় তালেবান সরকারকে সাহায্য করতে থাকে কিভাবে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করা যায়, নানান কাঠামো তৈরিতে সাহায্য করেন তিনি। এই সুযোগে বিন লাদেন নিজের একটা আর্মি গড়ে তুলতে সক্ষম হয় আফগানিস্তানে যার নাম হয় আল কায়েদা!
এভাবেই দেখা গেলো আমেরিকা যাদের সাহায্য করেছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তারাই আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে বসে ধর্মের নামে।
তালেবানরা যখন কাবুলে ক্ষমতা দখল করলো, তারা ভেবেছিলো আমেরিকা থেকে তো তারা সাহায্য পেতেই থাকবে। কিন্তু দেখা গেলো আমেরিকার আর কোন আগ্রহ নেই আফগানিস্তানের প্রতি। যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়ে গিয়েছিলো আর আমেরিকা এক রকম শীতল যুদ্ধে জয়ী হয়ে ছিল, তাই তারা আফগানিস্তানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলো এবং আফগানিস্তানকে আর কোন আর্থিক সাহায্য দিতে অস্বীকার করে!
টুইন টাওয়ার ধ্বংস, তালেবানের পতন ও পুনরুত্থান
তখনই তালেবান আর আমেরিকার মাঝে সম্পর্কের টানা পড়েন শুরু হয়। বিন লাদেন তখন ঘোষণা করে আমেরিকানরা মুসলমানদের শত্রু। তাদের হত্যা করতে হবে। এরপর ধারনা করা হয় কেনিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে আমেরিকান দূতাবাসে বিন লাদেনের আল কায়দা হামলা চালায়।
আমেরিকা তখন তালেবান নেতা মোল্লা ওমরকে এই বিষয়ে চাপ দিতে থাকে- বিন লাদেন তালেবান সহায়তায় সন্ত্রাসী হামলা করছে আমেরিকানদের বিরদ্ধে। কিন্তু মোল্লা ওমর সেটা অস্বীকার করে আমেরিকাকে ইসলামের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে।
এই সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের দুটো বিশাল মূর্তি, যা আগফানিস্তানে শত শত বছর ধরে ছিল, সেগুলো তালেবানরা গুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার পর পুরো পৃথিবী জুড়ে তালেবান বিরোধী একটা মনোভাব গড়ে উঠে! এভাবে তালেবানরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। এই সময় সৌদি আরব তালেবনাদের আর্থিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেয়।
বাকী থাকে কেবল পাকিস্তান। ২০০১, সেপ্টেম্বরের ১১ বা বহুল পরিচিত সেই ৯/১১; আমেরিকান টুইন টাওয়ারে দুটো বিমান এসে হামলে পড়লো। দুটো বিশাল বিশাল বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়লো পুরো পৃথিবীর সামনে।
তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তালেবানদের আলটিমেটাম দেয়, ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদার সদস্যদের আমেরিকার হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু তালেবান নেতা মোল্লা ওমর অস্বীকার করেন। আমেরিকার মাটিতে জঙ্গি হামলার জন্য আফগানিস্তান কিংবা আল কায়দা দায়ী নয় বলে মোল্লা ওমর মত দেন।
তালেবান নেতা মোল্লা ওমর ও আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মধ্যকার সম্পর্ক সব সময়ই রহস্যময় ছিল। মোল্লা ওমর লাদেনের পক্ষ নিয়ে ঘোষণা করে- “অর্ধেক আফগানিস্তান এমনিতেই রাশিয়ান আর্মি দ্বারা ধ্বংস হয়ে গেছে; বাকীটা যদি আমেরিকার জন্য হয় তো হোক। আমি মাথা নত করবো না এবং বিন লাদেন আমার অতিথি। আমরা অতিথির অসম্মান করতে পারি না”!
এই ঘোষণার পর আমেরিকা ক্ষিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখ আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসে। এভাবেই এক সময় যেই আমেরিকা ধর্মকে পুঁজি করে, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সোভিয়েত আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তালেবানদের সাহায্য করেছিলো; সেই আমেরিকাই আবার এই তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এভাবে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসান ঘটে।
তবে আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মোল্লা ওমর এবং তার অনুসারীরাও বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আমেরিকার আর্মির সহায়তায় এক ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় হামিদ কারজাই সরকারের মাধ্যমে।
কিন্তু দেখা গেলো এতেও আফগান সাধারণ মানুষের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন হলো না। হামিদ কারজাই সরকার কাবুলেই কেবল নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ভালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। বাকী প্রদেশ গুলোতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ তারা নিতে পারনি।
পাঁচ বছর পর ২০০৬ সাল থেকে দেখা গেলো তালেবানরা আবার বিভন্ন পাহাড়-পর্বত থেকে একত্রিত হয়ে ছোট ছোট অপারেশন চালাতে শুরু করলো আমেরিকান সেনাবাহিনীর উপর, যা এখনো চলছে!
আইএসের উত্থান ও আমেরিকার দায়!
এর মাঝে অবশ্য লুকিয়ে থাকা আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করতে সক্ষম হয় আমেরিকা। কিন্ত এতো দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ধর্মকে পুঁজি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যেই যুদ্ধ আমেরিকা নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলো; সেই ধর্মকে পুঁজি করে এখন আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইএস বা ইসলামিক স্টেট! যারা ইরাক, সিরিয়া লেবাননে এর মাঝেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
লক্ষ লক্ষ শরণার্থী পাশের দেশগুলো থেকে শুরু করে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে! এর শেষ কোথায় সেটা কারো জানা না থাকলে শুরু’টা যে আমেরিকার হাত ধরেই এসেছিলো, সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)