‘‘তারেক ভাইয়ের সাথে সাথে আরেক জনের কথা আমাদের কিন্তু বলতেই হবে, তিনি ক্যাথরিন মাসুদ। তারেক ভাই যা ভাবতেন, ক্যাথরিন সেটা এক্সিকিউট করতেন। তারা চিলেন যুগলবন্দি। এই দুজন মানুষ মিলে চলচ্চিত্রের একটা নতুন পৃথিবী তৈরি করেছিলেন। তারেক ভাইয়ের অনেক কাজ হয়তো এখনই বাস্তবায়ন করতে পারছে ক্যাথরিন, কিন্তু তারেক ভাইয়ের রেখে যাওয়া অনেক কাজ কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি সম্পূর্ণ করেছেন। আশা করি ভবিষ্যতে তারেক ভাইয়ের সব স্বপ্ন সফল করতে পারবেন।’’
প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুদিনে কথাগুলো বলছিলেন ‘মাটির ময়না’ খ্যাত অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী।
তারেক মাসুদ নেই ৭ বছর। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মৃত্যু হয় তার। একই দিনে দুর্ঘটনায় তার সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। তাদের দুইজন ছাড়াও আরো ৩ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুদিনে তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ। বিশেষ করে আগামী দিনের তরুণ নির্মাতাদের কাছে তারেক মাসুদ এক স্বপ্নের নাম। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংগঠন তার মৃত্যু দিনে আয়োজন করেছে স্মরণ সভার, কেউ বা আবার এই দিনে তারেক মাসুদের ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন রেখেছে।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় নাম তারেক মাসুদ। তার মৃত্যু দিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে চ্যানেল আই পরিবার। তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সোমবার(১৩ আগস্ট) দুপুরে চ্যানেল আইয়ের নিয়মিত আয়োজন ‘তারকা কথন’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় তারেক মাসুদের দুই কাছের মানুষকে। একজন নির্মাতা আবু সাইয়ীদ এবং অন্যজন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী।
তারেক মাসুদকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন রোকেয়া প্রাচী। মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করে তার সম্পর্কে প্রাচী বলেন, চলচ্চিত্রে তারেক ভাই যে শুধু তার শিল্পী বা বন্ধুদের ওয়েলকাম করতেন এমন না, ঢাকার বাইরের একদম নিউকামার যারা ফিল্ম বানাতে চায় বা ফিল্মে কাজ করতে চায়, অভিনয় করতে চায় তারা যদি তারেক ভাইকে নক করে তাদেরকেও তিনি ওয়েলকাম করতেন এবং তারা কী বলছেন শোনার চেষ্টা করতেন। ব্যাপারটা এমন না যে শুধু পরিচিতদেরই তারেক ভাই সুযোগ দিতেন। অপরিচিত একদমই নতুন যারা আমাদের চেনার গণ্ডিতেই না তাদেরও তারেক ভাই ওয়েলকাম করতেন।
ছোট বড় সবাইকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তারেক মাসুদ। এমনটা জানিয়ে প্রাচী আরো বলেন, সবাইকে এবং আমরা ‘মাটির ময়না’য় যারা অভিনয় করেছি আমাদের সাথে কিন্তু এতিমখানার বাচ্চারা ছিল এবং আনোয়ার(আনু) যে ছেলেটি ওর যে পরিচয় ছিল, তারেক ভাই তারপরেও তাদেরকে যেভাবে স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়েছেন, তা দেখে বোঝা যায়নি যে তারা কোন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী নন। এটা শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন সবাইকে।
তরুণ নির্মাতাদেরকে নানা ভাবে সহায়তা করতেন তারেক মাসুদ। এমনটা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আমি উনার সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে সম্পর্কটা বা আদর্শিক জায়গাটা শুধুমাত্র কাজ বা নির্দিষ্ট কোন ছবি কেন্দ্রিক তা না, নির্দিষ্ট ছবি ছাড়াও পুরো বাংলাদেশের যে ফিল্ম বা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সেটা নিয়েও তারেক ভাইয়ের সাথে আমাদের আলোচনা হত। এবং উনার ভাবনার জগৎ যে শুধুমাত্র উনার নিজের ছবিকে ঘিরে ছিল তা নয়, উনি ভাবতেন পুরো চলচ্চিত্র অঙ্গন নিয়ে, উনি ভাবতেন অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মিতারা কী করছেন তা নিয়ে বা স্ক্রিপ্ট রাইটাররা কী করছেন তা নিয়ে। কীভাবে তারা স্ত্রিপ্ট লিখলে বাইরের ফান্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করা যেতে পারে বা বাহিরের অর্গানাইজেশনগুলোর সাথে এড হওয়া যেতে পারে, এগুলো কিন্তু তিনি নিজে থেকেই করতেন এবং চাইতেন দলটা ভারি হোক চলচ্চিত্র নির্মাতার।
তারেক মাসুদের সেই তৎপরতার ফলেই আজকে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের মধ্যে বেশ পরিবর্তন হয়েছে উল্লেখ করে মেধাবী এই অভিনেত্রী আরো বলেন, আজকের যে একটা আবহ আমাদের চলচ্চিত্রে এটা কিন্তু তারেক ভাইয়ের একটা বড় অবদান আমি মনে করি। তিনি চাইতেন না যে তিনি একা বাইরে কাজ করবেন এমন না, তিনি এই দলটাকে বড় করতে চাইতেন। তিনি চাইতেন সবাই আসুক, চলচ্চিত্র পরিবারটা বড় হোক, সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ হোক। এবং আমাদের যারা ইয়াং আর্টিস্ট আছে বা ইয়াং মেকার আছে যারা চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন করে ভাবছে তারা সারা পৃথিবীর সাথে পরিচিত হোক। এই যে একটা বড় মনের মানুষ সবাইকে নিয়ে পথ চলবার যে ভাবনাগুলো, স্বপ্নগুলো এটা তার মধ্যে ছিল। উনি পথ দেখিয়ে দিতেন আমাদের এবং আমাদের সাথে নিয়ে চলতে চাইতেন।
যেকোন কাজের পেছনে আদর্শিক একটি জায়গার খুব প্রয়োজন। আমরা আজকে যে স্বপ্ন দেখছি ফিল্ম নিয়ে বা অভিনয় করছি, নিজেও নির্মাণ করার চেষ্টা করছি এর পেছেনে যে আদর্শিক জায়গাটা রয়েছে তার বড় একটি অবদান তারেক ভাইয়ের এবং তিনি তার এই আদর্শ অনেকের ভেতর ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।শিল্পীদের সন্মান করা বা চলচ্চিত্র পরিবারের সবাইকে পরিবার করে রাখা, দেশের জন্য কাজ করা, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভবিষ্যতকে দেখতে পাওয়া, দেশকে রিপ্রেজেন্ট করা এই ভাবনাগুলো তারেক মাসুদই আমাদের তৈরী করে দিয়েছেন। আজকে আমার মনে হয় তারেক মাসুদকে প্রয়োজন ছিল আমাদের, আমরা হয়ত আরো অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পারতাম তারেক ভাইয়ের হাত ধরে।-বলছিলেন রোকেয়া প্রাচী।
তারেক মাসুদের হাত ধরেই বিশ্ব চলচ্চিত্রের আবহ টের পেয়েছেন জানিয়ে রোকেয়া প্রাচী বলেন, আমরা প্রথম কিন্তু ‘মাটির ময়না’ র মাধ্যমেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে প্রথম কান চলচ্চিত্রে দেখতে পেয়েছি। এবং তারেক ভাইয়ের মাধ্যমেই আমি এবং জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় কান চলচ্চিত্রের বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আর এই আমন্ত্রিত অতিথির সন্মানটা কিন্তু তারেক ভাইয়ের মাধ্যমে। এবং ‘মাটির ময়না’র মাধ্যমে প্রথম অস্কারে ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম হিসেবে ‘মাটির ময়না’ মনোনীত হয়েছিল।