জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড হওয়ার পর দলটির পক্ষ থেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারেক রহমান একই মামলায় আসামি হিসেবে খালেদা জিয়ার চাইতে বেশি দণ্ডপ্রাপ্ত। তারেকের এই দণ্ড কারা ও অর্থ দুই দণ্ডেরই, অন্যদিকে খালেদা জিয়ার দণ্ড কেবল কারাবাসের। একই মামলায় মা-ছেলের দণ্ডিত হওয়ার পরেও দলের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত হলেন তারেক রহমান, আর বঞ্চিত হলেন দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্ব দেওয়া বেগম খালেদা জিয়া।
এ মামলাই নয়, এর আগেও তারেক রহমান আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। আইনি দিক থেকে তিনি পলাতক, তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে ‘মোস্টওয়ান্টেড’ হিসেবে রেডনোটিসও হয়েছিল। এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অনুপস্থিত তারেক রহমান। চিকিৎসার জন্যে দেশ ছাড়লেও পরে আর ফেরেননি দেশে। বিভিন্ন সময়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার কারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশে তার বক্তব্য প্রচারও দেশে বন্ধ রয়েছে।
বিএনপি দাবি করছে খালেদা জিয়ার ‘অনুপস্থিতিতে’ তারেক রহমান দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন। দলটির গঠনতন্ত্র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে এই ক্ষমতা দেয়। কিন্তু যে গ্রাউন্ডে খালেদা জিয়া অনুপস্থিত, সেই একই গ্রাউন্ডে তারেক রহমানও অনুপস্থিত।
তবে এই অনুপস্থিতি বিষয়ে তারেক রহমানের চাইতে খালেদা জিয়াই দলের কাছাকাছি অবস্থায়, কারণ তিনি দেশে আছেন। উচ্চ আদালত থেকে জামিনও নিতে পারবেন, তারেক রহমান দেশে নাই, সে হিসেবে জামিন নিয়ে বাইরে আসতে পারছেনও না। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি দলের জন্যে সাময়িক, কিন্তু তারেকের অনুপস্থিতি দীর্ঘমেয়াদী। আইনি দিক থেকে তারেক রহমান পলাতক।
রায়ে খালেদা জিয়ার কারাবাস নিশ্চিত হলে কীভাবে চলবে বিএনপি- গণমাধ্যমে এনিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা, কিন্তু এ ইস্যুতে বিএনপি কথা বলেনি। তারা অপেক্ষা করেছে রায়ের। তবে এই মধ্যবর্তী সময়ে রায়ে খালেদা জিয়ার কিছু হলে সারাদেশে আগুন জ্বলবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন নেতারা। দলের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হলে প্রয়োজনে তারাও ‘স্বেচ্ছায় কারাবরণ’ করবেন।
রায় হয়ে গেছে। দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। সংক্ষুব্ধ হয়ে দেশে বড় ধরনের শো-ডাউন করতে পারেনি বিএনপি। কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ ও সংঘর্ষে জড়িয়েছে, কিন্তু সেটা অনুমিত প্রতিবাদের মতো ছিল না। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে। রায়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে ব্যাপক ধরপাকড় হয়েছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এছাড়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন ছিল দেশের অনেক জায়গায়। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগি সংগঠনগুলো ছিল রাজপথে। তাছাড়া রাজপথের আন্দোলনে অপটু বিএনপি নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের রাজপথ দখলের কৌশলের কাছে মার খেয়েছে রাজনৈতিকভাবে।
কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পাওয়া তারেক রহমান আগে থেকে অন্য মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। খালেদা জিয়ার মতো তিনিও অনুপস্থিত দলের সকল প্রত্যক্ষ কার্যক্রম থেকে। খালেদা জিয়া দেশে থেকেও অনুপস্থিত ভাবছে দলটি, অথচ যে তারেক রহমান দেশেই আসতে পারছেন না জেলে যাওয়ার আশঙ্কায় তাকেই দলের দায়িত্ব দিয়েছে দলটি, তাও আবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।
একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, এরআগে একাধিকবার কারান্তরিন হয়েছিলেন খালেদা জিয়া; কিন্তু কখনই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন কাউকে নিয়োগ দেয়নি দলটি। এরশাদ সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়। গৃহবন্দি করে রাখা হয়। এরশাদবিরোধি আন্দোলনের শেষ সময়ে খালেদা জিয়া আত্মগোপনে গেলেও কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন করতে হয়নি বিএনপিকে।
এখন যে সময়ের মামলায় কারাগারে গেছেন খালেদা জিয়া সেই ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন খালেদা জিয়া। একটি বাড়িকে সাব-জেল ঘোষণা দিয়ে আটকে রাখা হয় তাকে। ওই সময় দলের স্থায়ী কমিটি প্রয়াত এম সাইফুর রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন নিযুক্ত করলেও বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীই সেটা মেনে নেয়নি। সাইফুর রহমানের ওই নিযুক্তি বহুল আলোচিত ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলার বিএনপি পর্যায়ের ‘মাইনাস খালেদা’র উদ্দেশে করা বলে অনেকেরই অভিযোগ।
এতবার জেলে যাওয়ার পরেও যখন খালেদা জিয়ার পদে অন্য কাউকে দরকার পড়েনি বিএনপির তখন এবার হঠাৎ কী হলো? খালেদার জামিনে মুক্তি চাওয়ার আগেই ধরে নিল খালেদা জিয়া ফিরছেন না সহসা। তারা কি ভাবছে খালেদার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ? কারাগারে যাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বিএনপি দলের নতুন চেয়ারপার্সনের খোঁজ পেয়ে গেল! আর নিয়ে আসল এমন একজনকে যে কীনা নিজেই খালেদা জিয়ার মতো একই মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত সহ আগের আরেক মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত; ইন্টারপোলের রেড-অ্যালার্ট যার নামে এসেছিল সেই তারেক রহমান!
এক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানোর সুযোগ নাই যে খালেদা জিয়ার অবর্তমানে দলকে চালাবেন তারেক রহমান। কারণ তিনি নিজেই দেশে অনুপস্থিত; উচ্চ আদালতের নির্দেশে দেশের মিডিয়াগুলোতে তার বক্তব্য প্রকাশ-প্রচার করা যাবে না। তাছাড়া যুক্তরাজ্যে তিনি আছেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে, আর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা কারও দেশে-বিদেশে রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার সুযোগ নাই। এসময়েও তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে বসে কিছু রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন যা হয়ত দৃষ্টির আড়ালে ছিল। এখন অফিসিয়ালি বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠানের কারণে যুক্তরাজ্যে থাকাটাই তার জন্যে কঠিন হয়ে পড়তে পারে! বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি যুক্তরাজ্য সরকারকে অবহিত করলে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন তারেক রহমান।
বিএনপিতে মা-ছেলের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বিষয়ক একটা গুজব রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এটা মাঝে মাঝে আলোচিত হয়, কিন্তু খালেদা জিয়ার কারাবাসের পর তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন হিসেবে নিযুক্তি এই অভিযোগকে অনেকটাই প্রতিষ্ঠা করে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তারেক রহমানের চাইতে খালেদা জিয়া ছিলেন সবচাইতে সুবিধাজনক অবস্থানে, তবু তারেকই হলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন! এবং সেটা কোন নিয়মনীতি না মেনেই।
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে চেয়ারম্যান বা চেয়ারপার্সনের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করবেন। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকলে কী প্রক্রিয়ায় দল পরিচালিত হবে সে বিষয়ে পরিস্কার করা নাই, তবে কিছু বিষয়ে সমাধানের জন্য জাতীয় স্থায়ী কমিটিকে ক্ষমতা দিয়েছে। দলটির গঠনতন্ত্রের ১২ (গ) জাতীয় স্থায়ী কমিটি অংশে বলা আছে, ‘এ কমিটির প্রয়োজনবোধে দলের ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র বিধি, উপবিধি ও ধারায় যথাযথ সংগতিপূর্ণ ব্যাখ্যা করবে এবং সে ব্যাখ্যা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।’
গঠনতন্ত্রের ৪ নং অনুচ্ছেদ অংশে কিছু শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কিন্তু ওখানে ‘অনুপস্থিতি’ বিষয়ক শব্দের ব্যাখ্যা নাই। কারাগারে যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানকে দায়িত্ব দিয়েছে বিএনপি, কিন্তু এনিয়ে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির আলাদা করে কোন সভা করেনি। রায়ের আগে খালেদা জিয়া স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার অবর্তমানে কাকে দেওয়া হবে দায়িত্ব এনিয়ে কোন আলোচনা করেননি, সিদ্ধান্তও দেননি। ফলে ধারণা করাই যায়, খালেদা জিয়া নিজেও চাননি চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে, পুত্র তারেক রহমানকেও চাননি তিনি। তাছাড়া এক মামলায় যেখানে দুইজনেরই দণ্ড হয়েছে সেক্ষেত্রে অপর দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া একদিকে যেমন যৌক্তিক নয়, অপরদিকে স্রেফ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আর সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা নিয়মতান্ত্রিকও নয়।
বিএনপির গঠনতন্ত্র চেয়ারম্যান বা চেয়ারপার্সনকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছে। ক্ষমতার ক্রমে দ্বিতীয় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। দুজনই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত; একজন কারাগারে, অপরজন বিদেশে পলাতক। তবু দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতককে দেওয়া হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্বের দায়িত্ব। নেতৃত্বে আসা তারেক রহমানের বার্তা সর্বসাধারণের জন্য গণমাধ্যমের দ্বারা প্রচারযোগ্য না হওয়ার কারণে দলটির এ পরিবর্তন আদতে বিএনপিকে বিপদেই ফেলবে।
ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করতে পারেনি, কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের মামলার সূত্র ধরে বিএনপিই খালেদা জিয়াকে দল থেকে ‘মাইনাস’ করে দিল!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)