মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে ইবাদতমুখর মাসটি হলো পবিত্র রমজান মাস। নানান ইবাদতের বাহার নিয়ে প্রত্যেক মুসলমানের ইমানী দরজায় হাজিরা দেয় মাসটি। এ মাসের মর্যাদাপূর্ণ সকল ইবাদতের মধ্যে তারাবিহ নামাজের অবস্থান একটি শীর্ষস্থানীয় ইবাদত। যা মাসের প্রতি রজনীতেই নিয়মমাফিক করে আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
তারাবিহ শব্দটি আরবি ‘তারবিহাতুন’ শব্দের বহুবচন। তারবিহাতুন অর্থ বিশ্রামগ্রহণ। আর বহুবচন ‘তারাবিহ’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায়– তিন বা ততোধিক বিশ্রামগ্রহণ। যেহেতু তারাবিহ নামাজের প্রতি চার রাকাত পরপর, অর্থাৎ ২০ রাকাত মাঝে সর্বমোট পাঁচবার বিশ্রাম নিয়ে থেমে থেমে এ নামাজটি আদায় করা হয়, তাই একে তারাবিহ নামাজ তথা বহু বিশ্রামযুক্ত নামাজ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এ নামাজটি কেবলমাত্র রমজান মাসের সাথেই সুনির্দিষ্ট। এজন্য একে ‘ক্বিয়ামে রমজান’ও বলা হয়।
তারাবিহ নামাজের ইতিহাস খুললে দেখা যায়, প্রথমদিকে নবী কারিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জামাতবদ্ধ হয়ে তারাবিহ নামাজ আদায় করতেন। অতঃপর ধারাবাহিক আদায়ের ফলে নামাজটি যখন ফরজ হয়ে যাবার উপক্রম হলো, তখনই জামাতবদ্ধ আদায়ের পরিবর্তে একাকী আদায়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বুখারি শরীফে এসেছে, “কোনো এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদে নামাজ আদায় করছিলেন। অতঃপর একই নামাজটি লোকেরাও তাঁর সাথে আদায় করলেন। পরবর্তী রাতে যখন নামাজটি আদায় করলেন, তখন জামাতে লোকসমাগম বেড়ে গিয়েছিল। এরপর তৃতীয় এবং চতুর্থ রাতে লোকেরা মসজিদে জড়ো হলেও তিনি সেখানে আগমন করেন নি। পরদিন সকালে সবার উদ্দেশ্যে বললেন: ‘তোমরা যা করেছো, আমি তা খেয়াল করেছি। কেবলমাত্র নামাজটি ফরজ হয়ে যাওয়ার আশংকাই আমাকে তোমাদের নিকট আগমন করা থেকে বিরত রেখেছে।’ আর এ ঘটনাটি ছিলো রমজান মাসের। (হাদিস নং: ১০৭৭, ১৯০৮)।
নবী কারিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে তারাবিহ নামাজের সর্বশেষ জামাত ছিলো এটিই। এরপর নামাজটি পুনরায় জামাতবদ্ধ আকারে চালু হয় হযরত ওমর (রা.)-এর যুগে এসে। যেমনটা অপর বর্ণনায় এসেছে– “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালের সূচনাভাগ পর্যন্ত তারাবিহ নামাজ এভাবেই (একাকী) আদায় হচ্ছিল। অতঃপর উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে হযরত ওমর (রা.) নির্দেশ দিলেন, নামাজটি যেন জামাতবদ্ধ আদায় করা হয় এবং তিনিও তাদের নিয়ে আদায় করলেন। আর এটিই ছিলো (রাসূলুল্লাহর পরে) তারাবিহ নামাজের সর্বপ্রথম জামাত।” (সহিহ ইবনে খুজাইমা- হাদিস নং: ২২০৭, সহিহ ইবনে হিব্বান- হাদিস নং: ১৪১)। এভাবে খলিফা ওমর (রা.)-এর নির্দেশে সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম তারাবিহ নামাজ জামাত সহকারে আদায় করেন। সেকাল থেকে অদ্য পর্যন্ত নামাজটি জামাতবদ্ধ হয়ে আদায়ের রীতিই বহাল রয়েছে।
তারাবিহ নামাজের অসংখ্য ফজিলত রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় ফজিলতটি হচ্ছে, এ নামাজ আদায়ের ফলে পূর্ববর্তী সকল সগীরা গুনাহ মার্জিত হয়ে যায়। মুসলিম শরীফের বর্ণনায়ও তেমনটা পাওয়া যায়– “যে ব্যক্তি ইমান সহকারে ও একনিষ্ঠমনে তারাবিহ নামাজ আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” (হাদিস নং: ৭৫৯)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে– “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য রোজাকে ফরজ করেছেন। আর আমি সুন্নাত করেছি তারাবিহকে। তাই যে ব্যক্তি ইমান সহকারে এবং একনিষ্ঠমনে রোযা ও তারাবিহ আদায় করবে, সে পাপ থেকে ঐদিনের দিনের মতো মুক্ত হবে, যেদিন মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ট হয়েছিল।” (নাসাঈ শরীফ- হাদিস নং: ২২১০)। এসকল হাদিস আমাদের জানিয়ে দেয় যে, তারাবিহ নামাজ আমাদের মুক্তির বার্তা নিয়ে আগমন করেছে।
তারাবিহ নামাজ একটি দীর্ঘাকৃতির নামাজ। স্বাভাবিকভাবে খতম তারাবিহ হলে নামাজটি আরো দীর্ঘায়িত হয়। খতম ধারায় কিংবা ছোট ছোট সূরা পাঠ– উভয় মাধ্যমেই তা আদায় করা যায়। যেহেতু করোনার এই সংকটকালীন মুহূর্তে মসজিদে গিয়ে খতম তারাবিহ আদায় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই উচিত হবে– পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আপন আপন ঘরেই নামাজটি জামাত সহকারে আদায় করে নেয়া। বড়-ছোট যেসকল সূরা মুখস্থ থাকবে, তা দিয়ে সুবিধানুযায়ী আদায় করে নেবে। যদি কুরআনের বড় সূরাগুলি কারো মুখস্থ না থাকে এবং সে তা দিয়ে কিংবা খতম সহকারে কুরআন দেখে দেখে নামাজটি দীর্ঘায়িত আকারে আদায় করতে চায়, সেক্ষেত্রে হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ বিধানমতে, দীর্ঘায়িত করার স্বার্থে ছোট সূরাগুলো বারবার পাঠ করবে। কোনোভাবেই কুরআন দেখে পড়া যাবে না। কেননা এতে ‘আমলে কাছীর’ তথা নামাজের বাহিরে প্রযোজ্য কার্য সংগঠিত হয়ে যায়। যা নামাজভঙ্গের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। (আল মুহীতুল বুরহানী: ১/৩১১, আল বাহরুর রায়েক: ২/১১)।
এ নামাজের রাকাতসংখ্যা নিয়ে বলতে গেলে তেমন মতভেদ কোনো নেই। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর তারাবিহ নামাজের বর্ণনাসমূহ থেকে এর রাকাতসংখ্যার ব্যাপারে বিশুদ্ধভাবে তেমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে বুখারি শরীফে বর্ণিত আট রাকাতের হাদিসটিকে কেউ কেউ তারাবিহ নামাজের রাকাতের ব্যাপারে বলে দাবি করলেও তা মূলত তাহাজ্জুদ নামাজের ব্যাপারেই বর্ণিত। কেননা হাদিসটি কিয়ামুল্লাইল তথা তাহাজ্জুদ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। অথচ তারাবিহকে ‘কিয়ামে রমজান’ বলা হয়; ‘কিয়ামুল্লাইল’ নয়। দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এছাড়া, বর্ণনাটিতে রমজান ও রমজানের বাইরে আদায়কৃত রাত্রিকালীন নামাজ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে, রমজান মাসের বাইরে কোনো তারাবিহ নেই; নামাজটি কেবল রমজানের সাথেই সুনির্দিষ্ট। সর্বোপরি, তারাবিহ শব্দটি বহুবচন, যা চার রাকাত পরপর তিন বা ততোধিক বিশ্রামের দাবিদার। সর্বনিম্ন তিনটি বিশ্রামই ধরে নিলে, সেক্ষেত্রে কমপক্ষে বারো রাকাত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অথচ তারাবিহ প্রসঙ্গে দাবিকৃত উক্ত হাদিসটি মাত্র আট রাকাতে সীমাবদ্ধ, যা তারাবিহ শব্দের নামকরণের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অতএব আট রাকাতের হাদিসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে ছিলো– এটিই বিশুদ্ধ মত।
তারাবিহ নামাজের রাকাতসংখ্যা নিয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের আলেমগণ একমত হয়েছেন যে, তারাবিহ নামাজ ২০ রাকাতবিশিষ্ট একটি নামাজ। তাদের এই অভিমতের পশ্চাতে, হযরত ওমর (রা.)-এর নির্দেশে আদায়কৃত জামাতবদ্ধ তারাবিহ নামাজের বর্ণনাগুলো শক্তিশালী প্রমাণ বহন করে। মুয়াত্তা ও বাইহাকী শরীফে এসেছে– লোকেরা হযরত ওমর (রা.)-এর যুগে (বিতরসহ) ২৩ রাকাত তারাবিহ নামাজ আদায় করতেন। (মুয়াত্তা- ২৫২, সুনানে কুবরা- ৪৩৯৪)। ইমাম ফারইয়াবি বলেন– হাদিসটির সনদ শক্তিশালী। (কিতাবুস সিয়াম- ১৭৯)। ‘মুগনী’ কিতাবে ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন– ‘এটি ইজমার ন্যায়’। অনেকে আবার ইজমাও বলেছেন। কেননা সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ২০ রাকাত সহকারে আদায় করেছেন। অথচ তাঁদের কেউই তা অস্বীকার করেন নি। ফলে ইজমা তথা ঐকমত্য সাব্যস্ত হয়েছে। আর ইসলামে ইজমার বৈপরীত্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই আমাদের উচিত হবে, সমাধানকৃত বিষয়টি নিয়ে সীমালঙ্ঘন না করা। পাশাপাশি সমগ্র রমজানজুড়ে নিয়মিত তারাবিহ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে হাদিসে বর্ণিত ফজিলত হাসিলের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখা।