৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘তামাকজাত দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ কর’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হয়ে আসছে। তামাক পণ্য সেবনের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং পরিবেশ দূষণ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৮ সালে তামাকমুক্ত দিবস পালনের ঘোষণা দেয়।
আমাদের দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠির প্রায় ৪ কোটি ১৩ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহার করছে। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ পুরুষ এবং ৭ লাখ মহিলা ধূমপান করছেন। আরো প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ পুরুষ এবং ১ কোটি ৩৪ লাখ মহিলা চর্বনযেগ্য তামাক ব্যবহার করেন। কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, তামাকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে আমাদেও দেশে প্রতি বছর ৫৭ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন এবং ৩ লাখ ৮২ হাজার জন পঙ্গুত্ব বরণ করেন। তামাক পণ্য সেবনের ফলে ১২ লাখ মানুষ প্রতি বছর প্রধান ৮টি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার, আলসার, হার্ট অ্যাটাক, ব্লাড প্রেসার, গ্যাস্টিক, ব্রেনস্ট্রোক, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, মুখে দুর্গন্ধ, ফুসফুস ক্যান্সার ইত্যাদি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ধূমপানের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন বা পদক্ষেপ না নিলে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ধুমপান মানুষের মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। ধূমপানজনিত রোগের কারণে ২৫% রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে বছরে দেশকে অর্থনীতিতে ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
তামাক খাতে বছরে ২ হাজার ৪ কোটি টাকা আয় হলেও নীট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬ কোটি টাকা। গেন্টাবাল এডাল্ট টোবাকো সার্ভে অনুসারে, বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৩ লাখ লোক পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার। এর মধ্যে ১ কোটি নারী। কর্মক্ষেত্রে ৬৩%, পাবলিক প্লেসে ৪৫% মানুষ ধুমপান করছেন।
চিকিৎসকরা বলেছেন, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের ফলে ২৫টি প্রাণঘাতী রোগের প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। তামাক বলতে শুধু বিড়ি বা সিগারেট সেবনকে বোঝায় না। পানের সাথে জর্দ্দা, সাদা পাতা, গুল, খৈন, নার্সি ইত্যাদিকেও বোঝায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষায়, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধূমপায়ী চিহ্নিত দেশ।
ট্রাস্ট ভিত্তিক সংগঠন হেলথ ব্রিজের তথ্য মতে, নিম্নবিত্ত ধূমপায়ীরা তাদের দৈনিক আয়ের সাড়ে ৪% ধূমপানে ব্যয় করেন। এ হিসেবে দৈনিক দেশে প্রায় ৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকার কেবল বিড়ি ও কমদামি সিগারেট বিক্রি হয়। বছরে হয় ৩ হাজার কোটি টাকার। এ দিয়ে দেশের খাদ্য চাহিদার অনেকটাই মেটানো সম্ভব। বছরের বিড়ি কেনার টাকায় দেশের ৫ বছরের নিচে প্রায় ৭০ লাখ অপুষ্টির শিকার শিশুদের দৈনিক এক গ্লাস দুধ বা দেড় কোটি অভূক্ত মানুষকে ৪’শ ক্যালোরি খাবার দেয়া সম্ভব।
হিসাব কষে দেখা গেছে, এ টাকায় বর্তমান বাজার মূল্যের প্রায় ৫ কোটি ডিম বা ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল অথবা ২৯ কোটি ছোট মুরগি বা ২৯ লাখ গরুর বাছুর কেনা সম্ভব।
তামাক পণ্যেও ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে যারা ভাবছেন তাদের ভাষায় তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও সেবনে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে। এ সব ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হচ্ছে মানুষের মধ্যে তামাক পণ্য ও ধূমপান বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলা। আগামী প্রজন্মকে এর ভয়াবহ দিক সম্পর্কে সচেতন করা।
প্রকাশ্য ধূমপান বন্ধ করা এখন তাই সময়ের দাবি। চিকিৎসকদের মতে, ধূমপান যিনি করেন তিনিই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না- এটা ধূমপায়ীরাও ভালো করে জানেন। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুরা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। ধূমপানের মত ভয়ংকর বদ অভ্যাসটি বদলাতে কেবলমাত্র ধূমপায়ীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিলেই চলে।